আসাদুজ্জামান খান কামাল, যিনি ‘কসাই কামাল’ হিসেবে বেশি পরিচিত। জুলাই গণ অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতাকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা, হেলিকপ্টার থেকে নিরস্ত্র নিরীহ মানুষের ওপর গুলি করা, কোলের শিশুকে হত্যা করে লাশ গুম করা, নারীদের নির্বিচারে আক্রমণ এসব ঘৃণ্য জঘন্য অপরাধে অপরাধী আসাদুজ্জামান খান কামাল। প্রশ্ন হলো, গত বছরের জুলাই মাসে কি হঠাৎ করে আসাদুজ্জামান খান কামাল নৃশংস হয়ে উঠেছিলেন? না, কামালের এই নৃশংসতা তার পুরো ১০ বছরের রাজত্বজুড়ে। ১০ বছরের বেশি সময় ধরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। এ সময় তিনি জুলুম নির্যাতন, হত্যা গুম করেছেন নির্বিচারে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, ভিন্ন মত দমনের জন্য তিনি নির্মম ছিলেন, কসাই ছিলেন। নিজস্ব আওয়ামী পেটোয়া বাহিনী তৈরি করেছিলেন পুলিশে এবং র্যাবে। যাদের মাধ্যমে সারা দেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। আওয়ামী ফ্যাসিস্ট মাসনে কামালই জল্লাদ। বিরোধী মত দমনে তার নেতৃত্বে তৈরি হয়েছিল ‘গেস্টাপো বাহিনী’। একদিকে যেমন তিনি অপরাধীদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করতেন, সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকার বিনিময়ে অবাধে তাদের অপরাধ করার সুযোগ করে দিতেন। গত ১০ বছরে তারাই ছিল ক্ষমতাবান। সারা দেশে কামালের নেতৃত্বে চালু হয়েছিল মাফিয়া তন্ত্র। অন্যদিকে এই সমস্ত অপরাধ, অন্যায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে যারাই কথা বলত, প্রতিবাদ করত তাদের ওপর নেমে আসত জুলুম, নির্যাতন, নৃশংসতা, গুম, খুন।
আসাদুজ্জামান খান কামাল এই সময় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘আয়না ঘর’। সেই ‘আয়না ঘরে’ নিয়ে যেয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর জুলুম, নির্যাতন করা হতো। র্যাবের ‘আয়না ঘরে’ নির্যাতিত হয়েছেন বিএনপি, জামায়াতসহ বিরোধী দলের প্রচুর নেতা। শুধু তাই নয়, বিরোধী দলের লোকদের দমন পীড়ন নির্যাতন করতেন তার আওয়ামী বাহিনী দিয়ে। ছাত্রলীগ, যুবলীগের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল অবৈধ অস্ত্র। তাদেরকে দিয়ে নির্বিচারে গুলি, হত্যা এবং জুলুম, নির্যাতনের ঘটনা ঘটানো হতো নিয়মিত ভাবে। আসাদুজ্জামান খান কামালের বিভিন্ন সময় যারা সহযোগী ছিল, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদ। এই বেনজীর আহমেদ একসময় ছিলেন পুলিশ কমিশনার। পরে তাকে করা হয় র্যাবের ডিজি এবং সবশেষে পুলিশের আইজিপি।
জানা গেছে, বেনজীরকে পুলিশের আইজিপি করার পিছনে আসাদুজ্জামান খানের বড় ভূমিকা ছিল। এখানে ছিল মোটা অঙ্কের লেনদেন। বেনজীর আইজিপি হওয়ার পর কামাল-বেনজীর জুটি সারা দেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। একদিকে জঙ্গি নাটকের মাধ্যমে ধর্মপ্রাণ মানুষকে হত্যা, নির্যাতন, অন্যদিকে ভিন্ন মতাবলম্বীদেরকে ‘আয়না ঘরে’ নিয়ে নির্যাতনের মতো ঘটনা ছিল নৈমিত্তিক ব্যাপার। এই সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছয় শতাধিক গুমের ঘটনার সঙ্গে জড়িত। ক্রসফায়ারের নামে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করেছিলেন শত শত। ক্রসফায়ারের নামে হত্যার নির্দেশ দিতেন আসাদুজ্জামান খান কামাল। ইলিয়াস আলী, কক্সবাজারের একরামসহ শতাধিক মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল আসাদুজ্জামান খান কামালের ১০ বছরের বেশি শাসনামলে। এসব তথ্য যারা প্রকাশ করত আসাদুজ্জামান খান কামাল বা তার সাঙ্গপাঙ্গদের গঙ্গের বিরুদ্ধে ন্যূনতম সংবাদ যারা প্রকাশ করত তাদের বিরুদ্ধে নেমে আসত খড়গ। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে বসুন্ধরা মিডিয়া গ্রুপের কথা। বসুন্ধরা মিডিয়া গ্রুপ বিভিন্ন সময় আসাদুজ্জামান খান কামলের দুর্নীতি, অনিয়ম, সন্ত্রাসীদের লুটপাট, দাপট ইত্যাদি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এসব প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য বারবার নিগৃহীত হয়েছে বসুন্ধরা মিডিয়া গ্রুপ। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে একের পর এক মামলা হয়েছে বাংলাদেশ প্রতিদিন, কালের কণ্ঠের বিরুদ্ধে। এই সব মামলাগুলোর নামে পুলিশ হয়রানি করা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা, হত্যা মামলা হয়েছে একের পর এক। বাংলাদেশ প্রতিদিনের কলাম লেখক ও রাজনীতিবিদ গোলাম মাওলা রনিকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বাংলাদেশ প্রতিদিন কার্যালয় থেকেই। ভিন্নমতের কলাম লেখার ওপর আরোপ করা হয়েছিল নিষেধাজ্ঞা। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বসুন্ধরা মিডিয়ার কণ্ঠরোধ করার জন্য তাদেরকে সরাসরি হুমকি দিয়েছিলেন আয়না ঘরে নিয়ে যাওয়ার। কিন্তু তারপরও যখন কাজ হয়নি, তখন অন্য পথ অবলম্বন করেন। একের পর এক বসুন্ধরা গ্রুপের বিরুদ্ধে মিথ্যা হয়রানি মূলক মামলা দিয়ে তাদেরকে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে। বিশেষ করে ‘বেনজীরের আলাদিনের চেরাগ’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশের পর সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রধান টার্গেট হয় বসুন্ধরা গ্রুপ।
গত বছরের ৩১ মার্চ বসুন্ধরা গ্রুপের অন্যতম সংবাদপত্র ‘কালের কণ্ঠে’ বেনজীরের আলাদিনের চেরাগ শিরোনামে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। এর পরে আসাদুজ্জামান খান কামাল ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন বসুন্ধরা গ্রুপের ওপর। এরপর একের পর এক করা হতে থাকে অসত্য মিথ্যা মামলা। বসুন্ধরার বিরুদ্ধে এসব মামলাগুলোর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন আসাদুজ্জামান খান কামাল। এসব মামলাগুলো করা হয়েছিল চিহ্নিত সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ ও মাদক ব্যবসায়ীদের দিয়ে, যারা আসাদুজ্জামান খান কামালের ঘনিষ্ঠ ছিলেন।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এ সময় বসুন্ধরা গ্রুপের বিরুদ্ধে অন্তত নয়টি বানোয়াট মিথ্যা মামলা করা হয়েছিল থানায় বা আদালতে। এসব মামলাগুলোর মধ্যে রয়েছে :
১. সিআর কেস নম্বর-২১/২৪। মামলার ধারা ৩২৩/৩২৪/৩৮০/৩৮৫/৪৫২/৫০৬/৩৪, মামলার বাদী মো. মোয়াজ্জেম হোসেন এবং জোবাইদা বেগম।
২. সিআর কেস নম্বর-৩৯/২০২৪, মামলার ধারা ৩২৩/৩২৪/৩৭৯/৩৮৫/৪৫২/৫০৬/৩৪ পিসি, মামলার বাদী মিজানুর রহমান।
৩. সিআর কেস নম্বর-৪৭/২০২৪, মামলার ধারা ৩২৩/৩২৪/৩৭৯/৩৮৫/৪৫২/৫০৬/৩৪, মামলার বাদী মো. এমদাদুল হক।
৪. সিআর কেস নম্বর-৪৮/২০২৪, মামলার ধারা ৩২৩/৩৭৯/৩৮৫/৪৫২/৫০৬/৩৪, মামলার বাদী আশিকুর রহমান।
৫. সিআর কেস নম্বর-৪৯/২০২৪, মামলার ধারা ৩২৩/৩৮০/৩৮৫/৪৫২/৫০৬/৩৪, মামলার বাদী মো. এমদাদুল হক।
৬. সিআর কেস নম্বর-৫০/২০২৪, মামলার ধারা ৩২৩/৩৮৫/৪৫২/৫০৬/৩৪, মামলার বাদী মো. এমদাদুল হক।
৭. সিআর কেস নম্বর-১০১৪/২৪, এনআই অ্যাক্ট (ঘও অপঃ) এর ১৩৮ ধারা, মামলার বাদী মো. রফিকুল ইসলাম।
৮. খিলক্ষেত পিএস কেস নম্বর-২০(৪)২৪, মামলার ধারা ১৪৩/৪৪৭/৩২৩/৩২৫/৪২৭/৩৭৯/৩৮৫/৫০৬/১১৪/৩৪ পি.সি, মামলার বাদী মো. সোহেল রানা।
৯. রূপগঞ্জ পিএস কেস নম্বর-২৩(৬)২৪, মামলার ধারা ১৪৩/৪৪৭/৪৪৮/৩২৫/৩২৬/৩০৭/৩৮০/৩৮৫/৪২৭/১১৪/১৪৯৫০৬(২) পি.সি।
এই ধরনের মামলার মাধ্যমে বসুন্ধরা মিডিয়ার কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা করা হয়েছিল আসাদুজ্জামান খান কামালের নেতৃত্বে। শুধু বসুন্ধরা গ্রুপ নয়, কোনো মিডিয়া হাউস কামালের বিরুদ্ধে লিখলেই সেই মিডিয়া হাউসের ওপর নিয়ে আসত খড়গ। বিশেষ করে বেনজীর আহমেদ যখন পুলিশের আইজিপি ছিল তখন পুরো দেশে সংবাদপত্র জগতে একটা ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই ত্রাসের রাজত্বের মূল হোতা ছিলেন আসাদুজ্জামান খান কামাল। বিরোধী দলের নেতাদেরকে গ্রেপ্তার করা, গুম করা শুধু নয়, টকশোতে ভিন্ন মতের কেউ কথা বললেও আসাদুজ্জামান খান তার বিরুদ্ধে নৃশংস কঠোর হতেন। এই নর কসাইয়ের হাত রক্তাক্ত। মানুষ খুন, গুম অপরাধ করে তিনি ‘কসাই কামাল’ উপাধি পেয়েছেন। যার চূড়ান্ত রূপ আমরা দেখতে পাই পয়লা জুলাই থেকে ৫ আগস্ট সময়ে। কোটা সংস্কার দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে গণহত্যার সূচনা করেন এই সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। শুধু তাই নয়, এ সময় যে সব গুলি নিপীড়ন নির্যাতনগুলো হয়েছে, আবু সাঈদ থেকে মুগ্ধ সব শহীদের রক্তের দাগ লেগে আছে আসাদুজ্জামান খান কামালের গায়ে। আসাদুজ্জামান খান কামাল শুধু একজন দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন হিঃস্র কসাই।