সরকারি চাকরিতে কোটাবৈষম্য নিরসনের লক্ষ্যে শুরু হওয়া আন্দোলন নতুন বাঁক নেয় ’২৪-এর ১৩ জুলাই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এদিন সরাসরি তৎকালীন সরকারের কাছে কোটা সমস্যার সমাধান এবং আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা পুুলিশের মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার চেয়ে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম ঘোষণা করে। কোটাবৈষম্য নিরসনে সংসদে আইন পাস করতে জরুরি অধিবেশন ডাকারও আহ্বান জানান তারা। ১৩ জুলাই সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে সংবাদ সম্মেলনে সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, এতদিন আমাদের বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি ছিল। এ কর্মসূচিকে অনেকে জনদুর্ভোগ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছেন। আমরা বলতে চাই, সুস্থ সন্তান জন্মদানের জন্য সাময়িকভাবে প্রসবকালীন ব্যথা সহ্য করতে হয়। আমাদের ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন ও ছাত্র ধর্মঘট চলছে। পরদিনের কর্মসূচি হিসেবে তিনি সব গ্রেডে কোটার যৌক্তিক সংস্কারের জন্য রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি প্রদান ও গণপদযাত্রা ঘোষণা করেন। সংসদে আইন পাস করে কোটার যৌক্তিক সংস্কার না করা পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা আন্দোলন চালিয়ে যাবে বলেও জানান তিনি।
এদিকে ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলন দিন দিন তীব্র আকার ধারণ করলেও সরকারের পক্ষ থেকে আন্দোলনের বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব দেখানো হয়। বক্তব্য-পাল্টা বক্তব্যে কোনো পক্ষই কাউকে ছাড় না দেওয়ার মানসিকতা তুলে ধরে। ১৩ জুলাই সরকারের একাধিক মন্ত্রী ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কথায় কঠোর মনোভাব ফুটে ওঠে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পৃক্ততার অভিযোগ তুলে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর ভূমিকা রাখবে বলে বক্তব্য দেন সরকারের একাধিক মন্ত্রী ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। এদিন আন্দোলনকারীদের দাবি ও বক্তব্যকে সংবিধান ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির বিরোধী বলে মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। রাস্তা বন্ধ না করে আন্দোলন থেকে সরে আসতে বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। আন্দোলনের নামে জানমালের ক্ষতি করলে কিংবা সড়ক অবরোধ করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যৌক্তিক ব্যবস্থা নেবে বলে হুঁশিয়ারি দেন তৎকালীন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) হারুন অর রশীদ।
চলমান আন্দোলনে পুলিশের যানবাহনে হামলা, ভাঙচুর এবং মারধরের অভিযোগ তুলে ওইদিনই রাজধানীর শাহবাগ থানায় মামলা দায়ের করে পুলিশ। আসামি হিসেবে উল্লেখ করা হয় ‘অজ্ঞাত পরিচয় অনেক শিক্ষার্থী’। এদিকে, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে না আসার জন্য ডোর টু ডোর ক্যাম্পেইন ও লিফলেট বিতরণ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেয় বর্তমানে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগ। আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলা হয়- ‘প্রফেশনাল আন্দোলনকারীরা’ ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের জন্য রাজপথে রয়েছে। আমরা তাদের সাবধান করে দিতে চাই। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কোনো ধরনের নৈরাজ্য মেনে নেবে না।
একই দিনে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এবং তাদের দাবি ন্যায্য হলেও সরকার ভিন্ন খাতে নিতে অপকৌশল করছে বলে মন্তব্য করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলন শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবি। এ ন্যায্য দাবির প্রতি বিএনপির সমর্থন আছে। আমাদের আশঙ্কা হচ্ছে- সরকার কোটা সংস্কার আন্দোলনে বিএনপির উসকানি আছে বলে অন্য দিকে ধাবিত করার অপকৌশল করতে পারে। তিনি আরও বলেন, ভোটারবিহীন ডামি সরকারকে হটানো আমাদের এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ। এ সরকারের পতন ঘটানো পর্যন্ত তারা রাজপথে থেকে আন্দোলন করবেন। কোটা সংস্কারের দাবিতে ওইদিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) দিনব্যাপী গণসংযোগ করেন আন্দোলনকারীরা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক হল ও সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুকে এ গণসংযোগ চালান তারা। এরপর রাত ৮টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে ৩৮ সদস্যের সমন্বয়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়।
একই দিন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে (জবি) কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের দুই সদস্যবিশিষ্ট কমিটি ঘোষণা করা হয়। এতে মেহেরুন্নেসা নিদ্রাকে প্রধান সমন্বয়ক ও মো. মারুফুল ইসলামকে সহসমন্বয়ক করা হয়।
এ ছাড়া কোটা সংস্কারের দাবিতে রাজবাড়ী রেলস্টেশনের সামনে রেললাইনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা। ঢাকাগামী মধুমতী এক্সপ্রেস আটকে দেন তারা।
জুলাই গণ অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে নানান কর্মসূচি পালন করছে রাজনৈতিক দলগুলো। ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থান থেকে গড়ে ওঠা বিপ্লবীদের রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি দেশব্যাপী পদযাত্রা ও পথসভা কর্মসূচি পালন করছে। আজ পিরোজপুর, ঝালকাঠি ও পটুয়াখালীতে চলবে তাদের এ কর্মসূচি।
আজ জুলাই শহীদ ও আহত পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ, মতবিনিময় ও দোয়া অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতারা।