শেয়ারবাজারে সম্প্রতি বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে নজরদারিতে আনতে উদ্যোগ নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এজন্য ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছে সংস্থাটি। চিঠিতে বিশেষ করে গত এক বছরে ৫০ লাখ টাকার বেশি মুনাফা করেছেন এমন বিনিয়োগকারীর বিস্তারিত তথ্য চাওয়া হয়েছে। দীর্ঘদিনের দরপতনে অস্থিতিশীল শেয়ারবাজার আগের তিন সপ্তাহ ধরে কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরে এলেও হঠাৎ করে এই চিঠি দেয় এনবিআর। এতে আবারও অস্থিতিশীলতা দেখা দিতে পারে শেয়ারবাজারে। বাজার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হঠাৎ এ ধরনের পদক্ষেপ বাজারে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পারে। তারা মনে করছেন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা বজায় রাখতে এনবিআরের উচিত হবে স্পষ্ট নীতিমালা ও সময়োপযোগী ব্যাখ্যা দেওয়া, যাতে বাজার স্থিতিশীল থাকে এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত না হন।
জানা গেছে, গত ২৫ আগস্ট এনবিআর থেকে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) এ-সংক্রান্ত চিঠি পাঠানো হয়। এতে উল্লেখ করা হয়, ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত স্টক এক্সচেঞ্জ তালিকাভুক্ত কোম্পানির সিকিউরিটিজ লেনদেন হতে ৫০ লাখ টাকার ওপরে মূলধনী আয় প্রাপ্ত স্বাভাবিক ব্যক্তি (ইন্ডিভিজ্যুয়াল ট্যাক্সপেয়ার) ও মূলধনী আয় নির্বিশেষে স্বাভাবিক ব্যক্তি ব্যতীত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের (আদার ট্যাক্সপেয়ার) অর্জিত মোট মূলধনী আয়-সংক্রান্ত তথ্য জরুরি ভিত্তিতে পাঠানোর জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো। চিঠিতে বলা হয়, ৫০ লাখ টাকা বা তার অধিক মূলধনী আয় প্রাপ্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তথ্য সংযুক্ত পত্রে বর্ণিত ছক মোতাবেক পাঠানোর জন্য নির্দেশক্রমে বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো। পাশাপাশি চিঠিতে এক্সচেঞ্জগুলোকে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে তথ্য সংগ্রহ করে সমন্বিত তালিকা কমিশনে পাঠানোর জন্য অনুরোধ করা হয়।
বিএসইসি তথ্যে দেখা গেছে, চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত সময়ে ৫০ কোটি ও তার বেশি বিনিয়োগ রয়েছে এমন বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) হিসাবধারী বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ১ হাজার ১৫০টি। ১০০ কোটি ও তার চেয়ে বেশি বিনিয়োগ থাকা বিও ৩৪৭টি এবং ৫০০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ রয়েছে ৭০ জন। ৭৩৩টি ব্যক্তি হিসাব রয়েছে যাদের ৫০ কোটি টাকা থেকে ১০০ কোটি টাকার মধ্যে বিনিয়োগ রয়েছে। এসব হিসাবধারীদের ৫০ লাখ টাকার মুনাফা হতে পারে। বাজার-সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, যাদের এমন বিনিয়োগ রয়েছে একাধিক হিসাবের মধ্যে মুনাফা বা লোকসান অন্তর্ভুক্ত থাকে। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের যদি দুটি বিও হিসাব থাকে একটির ৫০ লাখ টাকা মুনাফা হতে পারে আরেকটিতে ৬০ লাখ টাকা লোকসান থাকতে পারে। এই হিসাবে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ থেকে একজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সুনির্দিষ্টভাবে কত টাকা মুনাফা করেন কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষে তা নির্ধারণ করা সাধারণত কঠিন। একই সঙ্গে যারা মুনাফা করেন সংশ্লিষ্ট ব্রোকারেজ হাউস বা কোম্পানি থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কর বা অন্যান্য মাশুল সবকিছু কেটে রাখা হয়। তারপরে বড় বিনিয়োগ হঠাৎ করে টার্গেট হয়েছে। চিঠি পাওয়ার পর সিএসই থেকে সব ব্রোকারেজ হাউজে তথ্য পাঠানোর নির্দেশ দিয়ে একই রকম চিঠি দেয়। পরে চিঠির কার্যকারিতা স্থগিত করে। ডিএসই এই চিঠির কোনো প্রতিষ্ঠানকে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এনবিআরের এমন উদ্যোগে বাজারের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি ও আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। তারা মনে করছেন, এই চিঠি কর-সংক্রান্ত অনুসন্ধান বা নতুন কর আরোপের পূর্বাভাস হতে পারে। বিশেষ করে যারা বড় অঙ্কের লেনদেন করেছেন বা ধারাবাহিকভাবে উচ্চ মুনাফা করেছেন, তাদের মধ্যে শঙ্কা আরও বেশি। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, বিনিয়োগের ওপর বাড়তি কর বা তদন্তের চাপ বাজাওে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
জানতে চাইলে ডিএসইর পরিচালক মিনহাজ মান্নান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এনবিআর এমন চিঠি কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে দিতে পারে না। কর-সংক্রান্ত বিষয়টি পুরোপুরি করদাতা ও এনবিআরের মধ্যে সীমাবদ্ধ। বাণিজ্য সংগঠনকে নিশ্চয়ই চিঠি দিতে পারে না যে ওই সংগঠনের সদস্যরা কত টাকা আয় করে। এগুলো ব্যক্তিগত তথ্য। সেটা কীভাবে সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান চাইতে পারে? তিনি আরও বলেন, দীর্ঘদিনের রুগ্নদশা থেকে শেয়ারবাজার কিছুটা স্থিতিশীলতার দিকে যাচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা ফিরে আসা শুরু করেছে। এমন সময় এনবিআর থেকে এমন চিঠি বাজারকে চূড়ান্তভাবে নষ্ট করবে। কিছু অনৈতিক লোক হয়তো চাচ্ছে না শেয়ারবাজার ঘুরে দাঁড়াক। তারাই এ ধরনের কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত।