আফ্রিকার অন্যতম বৃহৎ জলপ্রপাত ভিক্টোরিয়া ফলসকে কেন্দ্র করে আবারও উঠেছে পুরোনো প্রশ্নটাই, কে সত্যিই এই জলপ্রপাতটি আবিষ্কার করেছিলেন? আগামী ১৬ নভেম্বর স্কটিশ মিশনারি ডেভিড লিভিংস্টোনের কথিত আবিষ্কারের ১৭০তম বছর পূর্ণ হচ্ছে। এই উপলক্ষে জিম্বাবুয়েতে নতুন করে আলোচনায় এসেছে উপনিবেশবাদ, নামের রাজনীতি এবং ঐতিহাসিক সত্য।
১৮৫৫ সালে লিভিংস্টোন যখন বর্তমান জিম্বাবুয়ে-জাম্বিয়া সীমান্তে অবস্থিত এই বিশাল জলপ্রপাতটি প্রথম দেখেন, তখনই তিনি একে ইউরোপের কাছে পরিচিত করে তোলেন। তাঁর ভাষায়, স্বর্গদূতরাও এমন দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হতো। কিন্তু বাস্তবে এর বহু আগেই স্থানীয় লোজি ও টোঙ্গা জনগোষ্ঠী প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই জলপ্রপাতের পাশে বাস করত এবং তারা এটির নাম রেখেছিল মসি-ও-য়া-তুন্যা, যার অর্থ গর্জন করা ধোঁয়া।
ইউরোপীয় নথিতে লিভিংস্টোনকে জলপ্রপাতের ‘প্রথম আবিষ্কারক’ বলা হলেও স্থানীয়রা এর বিরোধিতা করে আসছেন বহু বছর ধরে। তাদের মতে, স্থানীয় জনগোষ্ঠী যখন শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই জলপ্রপাতকে জানত, ব্যবহার করত এবং সাংস্কৃতিকভাবে শ্রদ্ধা করত, তখন একজন ইউরোপীয় পর্যটকের সেই স্থান দেখে নাম বদলানোর অধিকার কীভাবে আসে?
লিভিংস্টোন তার সহযাত্রী ব্রিটিশ অভিযাত্রী উইলিয়াম কটন অজওয়েলের সাথে মিলে জলপ্রপাতের নাম দেন ভিক্টোরিয়া ফলস, ব্রিটেনের রানি ভিক্টোরিয়ার নামে। রাজনৈতিক ভূগোলবিদদের ভাষায়, নামকরণ কখনোই নিরপেক্ষ নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, উপনিবেশবাদে স্থানের নাম পরিবর্তন ছিল ক্ষমতা প্রদর্শনের একটি কৌশল;স্থানীয় পরিচয় মুছে ফেলে নতুন রাজনৈতিক প্রতীক স্থাপন।
জিম্বাবুয়ের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. চিপো ডেন্ডেরে টিআরটি ওয়ার্ল্ডকে বলেন, এটা পুরোপুরি উপনিবেশবাদ। লিভিংস্টোন রানিকে খুশি করতে চেয়েছিলেন। আর এই নামে স্থানীয়দের নিজেদের ঐতিহ্যের উপর মালিকানাবোধ কমে গেছে। যদিও সরকার এখনো নাম বদলানোর আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ নেয়নি, ডেন্ডেরে জানান যে স্থানীয়রা দৈনন্দিন কথাবার্তায় আবারও ধীরে ধীরে মসি-ও-য়া-তুন্যা নামটিই ব্যবহার করতে শুরু করেছেন।
তবে নাম বদলের বিষয়টিকে সবাই সমর্থন করে না। ২০১৪ সালের একটি পর্যটন শিল্পের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, নাম পরিবর্তন করলে আন্তর্জাতিক পর্যটকদের পরিচিত ব্র্যান্ডিং বদলে যাবে এবং এতে ব্যবসায়িক ক্ষতি হতে পারে এমন আশঙ্কা রয়েছে শিল্পসংশ্লিষ্টদের মধ্যে।
বিশ্বজুড়েই এ নিয়ে একই ধরনের বিতর্ক দেখা যায়। পূর্ব আফ্রিকার লেক ভিক্টোরিয়ার স্থানীয় নাম ছিল ন্নালুবালে বা নামলোলোয়ে, অথচ ব্রিটিশ অভিযাত্রী জন হ্যানিং স্পিক লেকটির নাম দেন রানির নামে। একইভাবে, লেক অ্যালবার্টের স্থানীয় নাম মউইটানজিগে, পরে তা বদলে ব্রিটিশ রাজপরিবারের নামে রাখা হয়।
১৬ নভেম্বরকে শুধু লিভিংস্টোনের অভিযানের দিন হিসেবে দেখলে ইতিহাসের বড় অংশ অবহেলিত হয়। কারণ মসি-ও-য়া-তুন্যা কেবল একটি জলপ্রপাত নয় এটি আফ্রিকার মানুষের স্মৃতি, সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়ের জীবন্ত প্রতীক। নামটি কাদের অধিকার, সে প্রশ্নই এখন নতুন করে আলোচনা জাগাচ্ছে।
সূত্র: টিআরটি
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল