চব্বিশের জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচার শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে করা মামলার রায় পড়া শুরু হয়েছে।
সোমবার দুপুর ১২টা ৪০ মিনিটের দিকে বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদার রায় পড়া শুরু করেন। তিনি বলেছেন, এই রায় ৪৫৩ পৃষ্ঠার এবং ছয় ভাগে রায় ঘোষণা হবে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর অন্য দুই সদস্য হলেন- বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
প্রথম পর্যায়ে শুরুতে বিচারক ট্রাইব্যুনালের জুরিসডিকশন, আসামিদের বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগ এবং রোম স্ট্যাটিউট অনুযায়ী সুপিরিয়র কমান্ড রেসপন্সিবিলিটির গ্রাউন্ড আদালতে পড়ে শোনান।
আন্দোলন দমন করার জন্য প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার এবং হেলিকপ্টার থেকে গুলির ‘নির্দেশে’ দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এএসএম মাকসুদ কামাল এবং সাবেক মেয়ার শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে শেখ হাসিনার টেলিফোন কথোপকথন তুলে ধরেন তিনি।
একই সময়ে হেলিকপ্টার থেকে ‘ছত্রী সেনা নামানোর’ বিষয় শেখ হাসিনা এবং সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর কথোপকথন তুলে ধরা হয়।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষাপট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা এবং পরবর্তীতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি করে হত্যার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।
বিচারকাজ চলার সময় অডিও, ভিডিওসহ যেসব তথ্যউপাত্ত ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করা হয়েছে সেসবও বর্ণনা করেন বিচারক।
ঘটনার শিকার ও সাক্ষীরা কী বলেছে তার বর্ণনা দেওয়া হয়। ট্রাইব্যুনালে জুলাই গণ–অভ্যুত্থান চলাকালে বিভিন্ন ভিডিওতে পাওয়া শেখ হাসিনার মানবতাবিরোধী অপরাধের তথ্য–প্রমাণের বিবরণ দেওয়া হয়।
এছাড়া ঢাকার যাত্রাবাড়ী, রামপুরা, বাড্ডা, সাভার, আশুলিয়া, রংপুরসহ বিভিন্ন স্থানে যেভাবে প্রাণঘাতী গুলি ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের হত্যা করা হয়েছে, সেগুলোর ভিডিও ও তথ্যপ্রমাণের বিবরণ দেওয়া হয়।
এর আগে আন্দোলনের সময় মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রকাশিত রিপোর্টের বিভিন্ন অংশ পড়ে শোনায় ট্রাইব্যুনাল।
গণ–অভ্যুত্থান চলাকালে বিভিন্ন জনের সঙ্গে শেখ হাসিনার টেলিফোনে কথোপকথনগুলো শোনানো হয়। এর মধ্যে ছিল ঢাকা উত্তরের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক মাকসুদ কামালের সাথে ফোনালাপ।
আজ সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হয়। এ রায় ঘোষণা সরাসরি সম্প্রচার করছে বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি)। বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমও সরাসরি সম্প্রচার করছে।
গত ২৩ অক্টোবর প্রসিকিউশন ও আসামিপক্ষের আইনি যুক্তিতর্ক শেষ হলে এ মামলার রায় ঘোষণার তারিখ জানানোর জন্য ১৩ নভেম্বর দিন রাখেন ট্রাইব্যুনাল। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৩ নভেম্বর রায় ঘোষণার জন্য আজকের এই দিন ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল।
দেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কোনো সাবেক সরকারপ্রধানের বিরুদ্ধে এটিই প্রথম রায় হতে যাচ্ছে। এ মামলায় সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে আইনে। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণ অভ্যুত্থানে আন্দোলনরত ১৪০০ মানুষকে হত্যা ও ২৫ হাজারের বেশি মানুষ আহত হওয়ার ঘটনায় করা এ মামলায় আনা অভিযোগ প্রমাণ হলে শেখ হাসিনা এবং তার সহযোগীদের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড হবে নাকি অন্য কোনো সাজা দেওয়া হবে? এমন প্রশ্নের উত্তর জানতে সবার দৃষ্টি আজ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দিকে।
শেখ হাসিনা ছাড়া তার সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তার সময়ের সর্বশেষ পুলিশপ্রধান (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন এ মামলায় আসামি। শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল পলাতক। গণ অভ্যুত্থানে পতনের পর তারা পালিয়ে গিয়ে ভারতে অবস্থান করছেন। আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বর্তমানে কারাগারে। তিনি দোষ স্বীকার করে হয়েছেন রাজসাক্ষী (অ্যাপ্রুভার)। রাজসাক্ষী হিসেবে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্যও দিয়েছেন সাবেক এই আইজিপি।
আজকের এ রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে জুলাই অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারাধীন মামলাগুলোর মধ্যে প্রথম কোনো মামলার বিচারকাজ শেষ হতে যাচ্ছে। রায়ে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চাওয়ার পাশাপাশি ট্রাইব্যুনালের কাছে তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের আদেশ চাওয়া হয়েছে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে। আর এ দুই আসামির পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন তাদের বেকসুর খালাস চেয়েছেন।
মামলার বিবরণ : গত বছরের ৫ আগস্ট গণ অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। এরপর চলতি বছরের ২৫ মে থেকে ৮ অক্টোবরের মধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধে যেসব মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে, তার মধ্যে জুলাই-আগস্ট গণ অভ্যুত্থানের সময় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা মামলা আটটি। এর মধ্যে পাঁচটি মামলায় অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করেছেন ট্রাইব্যুনাল। বিচারাধীন পাঁচটি মামলার মধ্যে শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে এ মামলাটি ট্রাইব্যুনালের দ্বিতীয় মামলা।
বিডি প্রতিদিন/জুনাইদ