জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, কোনো বিদেশি শক্তির ইন্ধনে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়নি।
গতকাল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আইনজীবীর জেরায় তিনি এ কথা বলেন। বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১-এ তাকে জেরা করেন পলাতক আসামি শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন।
জেরা শেষে বেরিয়ে ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত সাংবাদিকদের নাহিদ ইসলাম বলেন, আওয়ামী লীগকে দলগতভাবে বিচারের আওতায় আনতে হবে। বিচারের মধ্য দিয়েই তাদের বিষয়ে ফয়সালা করতে হবে। ট্রাইব্যুনাল আইনেও সেই সুযোগ রয়েছে।
অন্যদিকে নতুন রাজনৈতিক সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশের (আপ বাংলাদেশ) প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক আলী আহসান জুনায়েদ ট্রাইব্যুনালে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেন, আমি সমন্বয়ক আসিফ ও সাদিক কায়েমের সঙ্গে কথা বলে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ৬ আগস্টের বদলে এক দিন এগিয়ে ৫ আগস্ট আনার পরামর্শ দিই। শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় প্রসিকিউশনের ৪৮তম সাক্ষী হিসেবে নিজের জবানবন্দি তুলে ধরেন। পরে তাকে জেরা করা শুরু করেন আসামিপক্ষের রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী।
এর আগে একই মামলায় প্রসিকিউশনের ৪৭তম সাক্ষী হিসেবে ১৭ ও ১৮ সেপ্টেম্বর ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দি দেন নাহিদ ইসলাম। পরে তাকে জেরা শুরু করেন আমির হোসেন। গতকাল তার সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। শেখ হাসিনার পাশাপাশি এ মামলার বাকি দুই আসামি হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। এর মধ্যে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন দোষ স্বীকার করে এ মামলায় রাজসাক্ষী হয়ে জবানবন্দি দিয়েছেন। গতকালও তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।
গতকাল ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে ছিলেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম, হাজী এম এইচ তামীম, আবদুস সাত্তার পালোয়ান, তারেক আবদুল্লাহ প্রমুখ। জেরার সময় নাহিদকে প্রশ্ন করে আইনজীবী আমির হোসেন বলেন, গত বছরের ৫ আগস্ট আপনার ওপর চলা অত্যাচারের জন্য কোনো মামলা করেছেন কি না। জবাবে নাহিদ বলেন, আমাদের বিরুদ্ধে যেসব অন্যায় হয়েছে, সেসব সমগ্র জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংঘটিত অন্যায় হিসেবে বিবেচিত হবে। এসব অন্যায় শুধু ব্যক্তিগতভাবে আমার বিরুদ্ধে করা হয়েছিল বলে মনে করিনি। সেজন্য ব্যক্তিগতভাবে কোনো মামলা করিনি। তবে গুমের ঘটনায় গুম কমিশনে আলাদা অভিযোগ দিয়েছি।
বিচারের মাধ্যমেই আওয়ামী লীগের বিষয়ে ফয়সালা করতে হবে : এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, আওয়ামী লীগকে দলগতভাবে বিচারের আওতায় আনতে হবে। বিচারের মধ্য দিয়েই তাদের বিষয়ে ফয়সালা করতে হবে। গতকাল ট্রাইব্যুনালে তার জেরা শেষ হলে এক ব্রিফিংয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
নাহিদ ইসলাম বলেন, আমার সাক্ষ্য দেওয়া জেরা আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়েছে। আদালতের কাছে ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করেছি। এটা অবশ্যই মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে। শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসে নয়, পৃথিবীর ইতিহাসে এই অপরাধ লেখা হয়ে থাকবে। তিনি বলেন, এ মামলায় ব্যক্তি হিসেবে শেখ হাসিনাকে আসামি করে মামলা চলমান। আমি মনে করি এটা শুধু ব্যক্তির সংঘটিত অপরাধ নয়, বরং এটা রাজনৈতিক অপরাধ। ফলে দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে বিচারের আওতায় আনা উচিত। ট্রাইব্যুনালের সে সুযোগ আছে। আমরা আবেদন জানাব। ট্রাইব্যুনালের কাছে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ এসেছে। শেখ হাসিনা যেহেতু দলীয় প্রধান, রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে জনগণের বিরুদ্ধে গিয়ে জনগণকে হত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। জনগণ প্রতিরোধ করে তাকে উৎখাত করেছিল। ফলে এটা রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগের সংঘটিত অপরাধ। আওয়ামী লীগকে দল হিসেবে বিচারের আওতায় দ্রুত সময়ে আনা উচিত।
নাহিদ বলেন, জুলাই আগস্টের আন্দোলনে গুলি চালিয়েছে, হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। তার (হাসিনার) বিরুদ্ধে এক দফা ঘোষণা করে তাকে উৎখাত করার প্রস্তুতি নেওয়া বৈধ। এখানে ষড়যন্ত্রের কিছু নেই। জনগণের পক্ষ থেকে এর বৈধতা ছিল। জনগণের অভ্যুত্থান হিসেবে জুলাই আগস্টের অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে। এখানে দেশি-বিদেশি শক্তির কোনো ইন্ধন ছিল না। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজপথে নেমে এসেছিল, জীবন দিয়ে প্রতিরোধ করে সফলতা নিয়ে এসেছে। শেখ হাসিনাসহ অন্যরা বিচারের মুখোমুখি হতে ভয় পেয়ে তারা দেশত্যাগ করেছে। দেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে।
‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি এগিয়ে আনতে পরামর্শ দিই : নতুন রাজনৈতিক সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশের (আপ বাংলাদেশ) প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক ৩৩ বছর বয়সি আলী আহসান জুনায়েদ আন্দোলনের শুরু থেকে যুক্ত থাকার কথা জানিয়ে জবানবন্দিতে বলেন, ২০ জুলাই সকালে আমরা আন্দোলনকারীরা কারফিউ ভঙ্গ করে আবার রাস্তায় বের হই এবং আন্দোলন চালিয়ে যাই। আন্দোলন কর্মসূচির ৯ দফা নির্ধারণ করে পেনড্রাইভে করে তা বিভিন্ন মিডিয়ার কাছে পাঠানো হয়। আন্দোলন থামানোর জন্য আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়। বলা হয়, যেহেতু ২১ জুলাই কোটা সংস্কার বিষয়ে আপিল বিভাগে একটি আদেশ হওয়ার কথা আছে, সেহেতু ছাত্রদের আন্দোলন বন্ধ করতে বলা হয়। ২১ জুলাই ৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। সেখানে গণহত্যার দায় স্বীকার করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানানো হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ দুজন মন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করা হয়। আন্দোলন চলাকালীন যাত্রাবাড়ী থেকে চিটাগাং রোড এলাকায় শতাধিক ব্যক্তি নিহত হয় ও কয়েক শতাধিক আহত হয়। এ সময়ের মধ্যে প্রায় ১৩৪ জনের লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে রায়েরবাজার কবরস্থানে দাফন করা হয়।
জবানবন্দিতে জুনায়েদ বলেন, ৪ আগস্ট যাত্রাবাড়ী এলাকায় আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাই। সেদিন পুলিশ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগ সম্মিলিতভাবে আন্দোলনকারীদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায়। সেদিন অনেকেই গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত ও আহত হয়। ওইদিন প্রথমে ৬ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। আমি সমন্বয়ক আসিফ ও সাদিক কায়েমের সঙ্গে কথা বলে কর্মসূচি এগিয়ে আনার পরামর্শ দিই। ৪ আগস্ট রাতে সমন্বয়ক আসিফ ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি এক দিন এগিয়ে এনে ৫ আগস্ট করার ঘোষণা দেন।
আবু সাঈদকে বাঁচাতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হই : গত বছর ১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ^বিদ্যালয়ের (বেরোবি) শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে বাঁচাতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন বলে জানিয়েছেন সিয়াম আহসান আয়ান নামের এক সাক্ষী। গতকাল বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ-২-এ এই মামলায় প্রসিকিউশনের ষষ্ঠ সাক্ষী হিসেবে দেওয়া জবানবন্দিতে এসব কথা বলেন তিনি। পরে তাকে জেরা করা শুরু করেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। এই জেরা অসমাপ্ত থাকায় পুনরায় জেরার জন্য আজকের দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল-২।
জবানবন্দিতে আয়ান বলেন, পুলিশ বাহিনী আমাদের ওপর টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে, যার প্রতিবাদে আবু সাঈদ রাস্তার আইল্যান্ডের পশ্চিম পাশে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর গেট বরাবর দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে যায়। পুলিশ বাহিনী থেকে তাকে শুট করা হয়। তখন আমি বিয়াম শপিং কমপ্লেক্সের সামনে রাস্তার পূর্ব পাশে অবস্থান করছিলাম। সেখান থেকে আমি আবু সাঈদকে দেখতে পারছিলাম। গুলি খেয়ে আবু সাঈদ তার ব্যালেন্স হারিয়ে আইল্যান্ডের পূর্ব পাশে চলে আসে। তখন আনুমানিক ২টা ১৭ মিনিট। আমি আবু সাঈদ ভাইকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে আসি। তখন তাকে আমি তুলে আমার ডান পাশে অর্থাৎ পূর্ব পাশে ঘুরিয়ে নেই। পুলিশের পক্ষ থেকে আবারও গুলি করা হয় এবং সেই গুলিতে আমি আহত হই।