ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েই ইসরায়েলের মতো প্রতিপক্ষকে বাগে আনছে ইরান। বিশ্লেষকদের মতে, ক্ষেপণাস্ত্রই ইরানের মূল চালিকা শক্তি। ক্ষেপণাস্ত্র আছে বলেই ইরানকে পশ্চিমা দেশগুলো সমীহ করে চলে।
১২ই নভেম্বর ছিলো ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির জনক এবং দূরদর্শী সামরিক কৌশলবিদ হিসেবে পরিচিত হাসান তেহরানি মোকাদ্দামের শাহাদাৎ বার্ষিকীর ১৪তম বছর পূর্ণ হলো। তিনি এমন একজন নেতা ছিলেন যিনি তার সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে ছিলেন।
১৯৮০’র দশকে চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধের সময় তেহরানি মোকাদ্দাম ইরানের নিজস্ব ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা উন্নয়নে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি বহু মহাকাশ কমান্ডারকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করেছিলেন, যারা তার মৃত্যুর পরেও এই অভিযানকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন।
১৯৫৯ সালে তেহরানের সারচেশমেহ এলাকায় তার জন্ম। তিনি ১৯৭৭ সালে উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষা সম্পন্ন করেন এবং ১৯৭৯ সালে শরীফ ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এর দুই বছর পর তিনি খাজে নাসির আল-দীন তুসি ইউনিভার্সিটি থেকে শিল্প প্রকৌশলে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
ইসলামি বিপ্লবী গার্ড কোর (আইআরজিসি) প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময়, মাত্র ২১ বছর বয়সে তেহরানি মোকাদ্দাম আইআরজিসির উত্তর ইরানের তৃতীয় অঞ্চলের গোয়েন্দা বিভাগে একজন তরুণ ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন।
১৯৮১ সালে সফল 'সামেন-ওল-আইমেহ' অভিযানের পর, যেখানে দক্ষিণ-পশ্চিম খুজেস্তানের আবাদান শহর পশ্চিম-সমর্থিত ইরাকি বাথবাদী বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত হয়, তিনি ফ্রন্টলাইনে ফায়ার সাপোর্ট জোরদার করার জরুরি প্রয়োজন উপলব্ধি করেন। এই উপলব্ধি তাঁকে একটি পরিকল্পনা তৈরি করতে উৎসাহিত করে, যা তিনি তৎকালীন আইআরজিসি গোয়েন্দা প্রধান হাসান বাঘেরির কাছে জমা দেন। তার প্রস্তাবের পর আহভাজে আইআরজিসি আর্টিলারি কোর এবং আর্টিলারি গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
তেহরানি মোকাদ্দাম ১৫৫ মিমি এবং ১৩০ মিমি ট্র্যাকশন শেল, পাশাপাশি পর্তুগিজ ১০৫ মিমি শেল ব্যবহার করে আইআরজিসি আর্টিলারি স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে, যখন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা সরকারগুলোর সমর্থনে ইরাক ইরানি শহরগুলোতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা বাড়াচ্ছিল, তখন সীমিত বিদেশী সহায়তার মাধ্যমে ইরান তার ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষার ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করে।
তার দূরদর্শী নেতৃত্বে আইআরজিসি অর্জিত প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইরানের প্রথম দেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি শুরু করে এবং সফলভাবে ১৯৮৫ সালের মার্চ মাসে ইরাকি শহর কিরকুকে প্রথম ক্ষেপণাস্ত্রটি উৎক্ষেপণ করা হয়। দ্বিতীয় ক্ষেপণাস্ত্রটি বাগদাদের একটি ১৮ তলা সামরিক ভবনে আঘাত হানে, এরপর আরেকটি ক্ষেপণাস্ত্র একই শহরের ইরাকি সেনা অফিসার্স ক্লাবে আঘাত করে, যাতে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িত প্রায় ২০০ বাথবাদী সামরিক কমান্ডার নিহত হন।
১৯৮৬ সালে তেহরানি মোকাদ্দাম আইআরজিসি বিমান বাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্র বিভাগের কমান্ডার নিযুক্ত হন এবং এর কয়েক মাস পরে তিনি লেবাননের হিজবুল্লাহ প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রথম ক্ষেপণাস্ত্র ইউনিট প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেন। যুদ্ধের শেষ দুই বছরে তিনি নাজিয়াত এবং ওঘাব-এর মতো স্বল্প-পাল্লার কৌশলগত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বা রকেট আর্টিলারি সিস্টেম তৈরি করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, যা ছিল দেশের প্রথম দিকের ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম।
যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে তিনি ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র শিল্পের অগ্রগতিতে নেতৃত্ব দিতে থাকেন। ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা, ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা ও প্রযুক্তির উন্নতি ঘটান, যার ফলস্বরূপ শাহাব ও জেলজাল ক্ষেপণাস্ত্র সিরিজের জন্ম হয়। ১৯৮০-এর দশকে ইরানের কাছে ৪৫ কিমি পাল্লার ওঘাব এবং ১০০ কিমি পাল্লার নাজিয়াত ছিল, যা পরবর্তীতে ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে মাঝারি-পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের পথ প্রশস্ত করে এবং পরের দশকে আশুরা ও সেজ্জিলের মতো অসংখ্য নতুন মডেল তৈরি হয়।
বহু বছর ধরে তাঁর প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ ইরান এখন প্রধান ক্ষেপণাস্ত্র শক্তিতে পরিণত হয়েছে। ইরানের বিশাল ক্ষেপণাস্ত্র ভান্ডার যেকোনো প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করতে সক্ষম, যার মধ্যে অবৈধ জায়নবাদী সত্তাও রয়েছে।
২০১১ সালের ১২ই নভেম্বর তেহরানের পশ্চিমে মালার্দ শহরের আমির আল-মু'মিনিন গ্যারিসনে ১৬ জন কমরেডসহ তেহরানি মোকাদ্দাম শাহাদাৎ বরণ করেন। তাকে এবং তার সহকর্মীদের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মানে তেহরানের বেহেশত-এ জাহরা কবরস্থানে সমাহিত করা হয়, যেখানে ১৯৮০-এর দশকের যুদ্ধের অনেক শহীদও শায়িত আছেন।
তেহরানি মোকাদ্দাম বলেছিলেন, যখন আমি মারা যাব, আমার কবরে লিখবে: এখানে সেই ব্যক্তি শায়িত আছেন যিনি ইসরায়েলকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন।
জেনারেল মুসাভি এখন আইআরজিসি অ্যারোস্পেস বিভাগের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তিনি তার পূর্বসূরি জেনারেল আমির আলি হাজিজাদেহের শাহাদাৎ বরণের পর এই পদে এসেছেন। জেনারেল হাজিজাদেহ ছিলেন তেহরানি মোকাদ্দামের স্কুল অফ থট ও প্রশিক্ষণের সেরা শিষ্যদের মধ্যে একজন, যিনি এই বছরের শুরুতে তার শাহাদাৎ বরণ পর্যন্ত তার অসমাপ্ত অভিযানকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।
তেহরানি মোকাদ্দামের উত্তরাধিকার আজকের দিনে ইরানের শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র ও মহাকাশ কর্মসূচিতে স্পষ্ট। এই কর্মসূচি নিঃসন্দেহে বিশ্বের সেরা, যা এই মহান কমান্ডারের অসাধারণ উত্তরাধিকারের এক গর্বিত প্রমাণ।
সূত্র: মেহের নিউজ
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল