জুলাই-আগস্ট গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকের শাসনামলে গুম করে আটক রাখা ও নির্যাতনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের পৃথক দুই মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করেছে প্রসিকিউশন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা মামলা দুটিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সেনাবাহিনীর বর্তমান ও সাবেক বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাসহ ২৮ জনকে আসামি করা হয়েছে। একই সঙ্গে রাজধানীর রামপুরায় গত বছর ১৮ ও ১৯ জুলাইয়ের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দাখিল করা আনুষ্ঠানিক অভিযোগে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) দুই কর্মকর্তাসহ চারজনকে আসামি করা হয়েছে।
গতকাল বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল পৃথক এই তিন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নিয়ে ৩২ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। ২২ অক্টোবর পরবর্তী তারিখ রেখে এই সময়ে আসামিদের গ্রেপ্তার করে হাজির করার নির্দেশও দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। গুমের দুটি মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের পর তা ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। এর মধ্যে একটি মামলায় ১৩ জন এবং অন্য মামলায় ১৭ জনকে আসামি করা হয়েছে। তবে শেখ হাসিনা এবং তার প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক দুটি মামলায়ই কমন আসামি হিসেবে থাকায় মোট আসামি সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৮ জন।
অন্যদিকে রামপুরায় হত্যাকাণ্ডের মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম। এ মামলায় দুজন বিজিবি কর্মকর্তাসহ চারজনকে আসামি করা হয়েছে।
শুনানির সময় ট্রাইব্যুনালকে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, গুমের শিকার ব্যক্তির হাত কাটাসহ নখ উপড়ে ফেলা, ঘূর্ণায়মান চেয়ারে বসিয়ে বা ইলেকট্রনিক শক দিয়ে ভয়ংকর সব নির্যাতন করা হতো। তাদের আলাদা কোড নেম ছিল। বিশেষ বন্দিদের ডাকা হতো মোনালিসা নামে। আর গুমঘরকে বলা হতো আর্ট গ্যালারি। পরবর্তী সময়ে আয়নাঘর হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে এ নাম। তিনি বলেন, হাসপাতাল বা ক্লিনিক নামেও ডাকা হতো র্যাবসহ বিশেষ বাহিনীর এসব বন্দিশালাকে। আর গুমের শিকার ভুক্তভোগীদের বলা হতো সাবজেক্ট।
এসময় ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন শেখ হাসিনা সরকারের আমলে গুমের শিকার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুল্লাহিল আমান আল আযমী, ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাসেম (আরমান), হুম্মাম কাদের চৌধুরী, সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল হাসিনুর রহমান বীরপ্রতীক ও মাইকেল চাকমাসহ কয়েকজন।
আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেওয়ার পর চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, আমরা এটার মাধ্যমে একটি স্পষ্ট বার্তা দিতে চাই। অপরাধ যারা করবেন, আইনকে যারা নিজের হাতে তুলে নেবেন, তাদের অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। এটা ন্যায়বিচারের দাবি, এটা সভ্যতার মূল কথা। তিনি বলেন, এখানে আবার গুমের সংস্কৃতি ফেরত আসুক, ক্রস ফায়ারের সংস্কৃতি ফেরত আসুক, মানুষের হাত-পা, নাড়িভুঁড়ি কেটে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়ার সংস্কৃতি কখনো ফেরত আসুক, এটা বাংলাদেশের কেউ আর চায় না।
গুমের দুটি মামলার একটি করা হয়েছে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে (জেআইসি) আটক রেখে নির্যাতনের ঘটনায়। এই মামলায় মোট পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিকসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে।
বাকি ১১ আসামির মধ্যে পাঁচজন ডিজিএফআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক। তারা হলেন- লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. আকবর হোসেন, মেজর জেনারেল (অব.) মো. সাইফুল আবেদিন, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. সাইফুল আলম, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আহমেদ তাবরেজ শামস চৌধুরী ও মেজর জেনারেল (অব.) হামিদুল হক। বাকি ছয় আসামি হলেন- ডিজিএফআইয়ের সিটিআইবির সাবেক পরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ তৌহিদুল উল ইসলাম, ডিজিএফআইয়ের সিটিআইবির সাবেক পরিচালক মেজর জেনারেল শেখ মো. সরওয়ার হোসেন, ডিজিএফআইয়ের সিটিআইবির সাবেক পরিচালক মেজর জেনারেল কবীর আহাম্মদ, ডিজিএফআইয়ের সিটিআইবির সাবেক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমান সিদ্দিকী, ডিজিএফআইয়ের সিটিআইবির সাবেক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমেদ তানভির মাজাহার সিদ্দিকী ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মখছুরুল হক। গুমের অন্য মামলাটি করা হয়েছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) টাস্কফোর্স ফর ইন্টারোগেশন (টিএফআই) সেলে আটকে রেখে নির্যাতনের ঘটনায়। এ মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক পুলিশ প্রধান (আইজিপি) বেনজীর আহমেদসহ ১৭ আসামির বিরুদ্ধে। আসামিদের বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে। মামলার অন্য আসামিরা হলেন- র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক এম খুরশীদ হোসেন, র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক মো. হারুন-অর-রশিদ, র্যাবের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপস) কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান, র্যাবের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপস) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম, র্যাবের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপস) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার, র্যাবের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপস) কর্নেল কে এম আজাদ, র্যাবের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপস) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. কামরুল হাসান।
এ মামলার আরও আসামি হলেন- র্যাবের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপস) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহাবুব আলম, র্যাবের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপস) কর্নেল আবদুল্লাহ আল মোমেন, র্যাবের সাবেক পরিচালক (ইন্টেলিজেন্স উইং) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. সারওয়ার বিন কাশেম, র্যাবের সাবেক পরিচালক (ইন্টেলিজেন্স উইং) লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মুহাম্মাদ খায়রুল ইসলাম, র্যাবের সাবেক পরিচালক (ইন্টেলিজেন্স উইং) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মশিউর রহমান জুয়েল এবং র্যাবের সাবেক পরিচালক (ইন্টেলিজেন্স উইং) লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল ইসলাম সুমন।
আর ১৮ ও ১৯ জুলাই রাজধানীর রামপুরায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা মামলার আসামিরা হলেন-বিজিবির সাবেক কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেদোয়ানুল ইসলাম, মেজর মো. রাফাত বিন আলম মুন, ডিএমপির খিলগাঁও অঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) মো. রাশেদুল ইসলাম ও রামপুরা থানার সাবেক ওসি মো. মশিউর রহমান। এই আসামিদের বিরুদ্ধে ৬টি অভিযোগ এনেছে প্রসিকিউশন।
অপরাধ করলে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে : আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেওয়ার পর চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন- ‘বিগত সরকারের আমলে ১৫ বছরে গুম, গোপন বন্দিশালায় আটক, নির্যাতন, হত্যাকাণ্ডসহ নানা ধরনের যে অপরাধ হয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারে এই প্রথম চার্জশিট দাখিল হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে চিফ প্রসিকিউটরের অফিসের পক্ষ থেকে আমরা ফরমাল চার্জ দাখিল করেছি আদালতে। ট্রাইব্যুনাল সব অভিযোগের বর্ণনা শুনেছেন। শোনার পর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নিয়েছেন এবং তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন।
তিনি বলেন, আমরা এটার মাধ্যমে একটি স্পষ্ট বার্তা দিতে চাই। অপরাধ যারা করবেন, আইনকে যারা নিজের হাতে তুলে নেবেন, অপরাধীকে অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। এটা ন্যায়বিচারের দাবি, এটা সভ্যতার মূল কথা। অপরাধীর বিচার করার সময় কখনোই দেখা হয় না, অপরাধী কত উঁচু স্তরের, কত ক্ষমতাশালী অথবা অপরাধী কোন ব্যক্তি। আমরা এখানে যেমন সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে, সাবেক আইজিপিকে, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে, ক্যাবিনেটের সদস্যদের আসামি করেছি, তেমনি বিভিন্ন বাহিনীতে যারা দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে জনগণের আস্থা, জনগণের বেতন নিয়ে, ইউনিফর্ম পরে রাষ্ট্র-সংবিধান এবং আইনের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন, অপরাধ করেছিলেন, তাদেরও আসামি করা হয়েছে। বিভিন্ন বাহিনীর সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাদের আসামি করা নিয়ে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, তাদের অপরাধের দায় কেবলমাত্র এই ব্যক্তিদেরই। তাদের অপরাধের দায় রাষ্ট্র, সমাজ, প্রতিষ্ঠান বহন করবে না। আজকে যারা আসামি শ্রেণিভুক্ত হয়েছেন, আমরা স্পষ্ট মেসেজ দিতে চাই- তারা যে বাহিনীর সদস্যই হোন না কেন, সেই বাহিনীগুলো কোনো অবস্থাতেই আসামি নয়। আসামি হচ্ছেন এই ব্যক্তিরা। এই ব্যক্তিরা আইন অনুসরণ না করে নিজেরা আইনকে হাতে তুলে নিয়েছিলেন এবং বাংলাদেশটাকে একটি বধ্যভূমিতে পরিণত করেছিলেন। বাংলাদেশটাকে একটি আতঙ্কের জনপদে পরিণত করেছিলেন। ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সদ্য সংশোধিত বিধান উল্লেখ করে চিফ প্রসিকিউটর সাংবাদিকদের বলেন- আসামিদের মধ্যে কেউ কেউ বিভিন্ন বাহিনীর সদস্য। তাদের মধ্যে কেউ কেউ অবসরে গেছেন, অধিকাংশই এখনো ইন সার্ভিস আছেন। কে সার্ভিসে আছে কি নেই, সেটা আসলে আমাদের বিবেচ্য বিষয় নয়।
আমরা দেখছি অপরাধকে। অপরাধ যদি কোনো প্রধানমন্ত্রী করেন সেটা অপরাধ, অপরাধ যদি কোনো বাহিনীর দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি করেন, তাহলেও অপরাধ, কোনো সিভিলিয়ান যদি করে তাহলেও অপরাধ। সুতরাং আমরা অপরাধকে খুঁজছি, কোনো সংস্থা বা অন্য কাউকে নয়। আজকে ফরমাল চার্জ দাখিল হওয়া মাত্রই সংশোধিত আইন অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি প্রজাতন্ত্রের কোনো চাকরিতে থাকতে পারবেন না। সুতরাং ফরমাল চার্জ দাখিল হওয়া মাত্রই এই মুহূর্ত থেকে যারা সার্ভিসে আছেন, তারা আর সার্ভিসে আছেন বলে গণ্য হবে না।
আসামিদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে তিনি বলেন- গ্রেপ্তারি পরোয়ানা যখন জারি হয়েছে, আইনের যে নির্ধারিত পদ্ধতি আছে সেই অনুযায়ী গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকর করার জন্য রাষ্ট্রের যে সংস্থাগুলো আছে, তাদের প্রতি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আসামিরা পুলিশ বাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনীতে চাকরিরত আছেন। সেসব বাহিনীর অফিশিয়ালদেরও আমরা আদেশের কপি সরবরাহ করার জন্য আদালতে আর্জি জানিয়েছিলাম। আদালত তা মঞ্জুর করেছেন। সুতরাং আমরা আশা করছি দ্রুততম সময়ের মধ্যে আদালতের নির্দেশ সব জায়গায় পৌঁছে যাবে এবং এই আসামিরা যে যেখানেই আছেন, সেখান থেকেই তাদের গ্রেপ্তার করা হবে। আসামিরা এখন থেকে কেউ সার্ভিসে আছেন বলে গণ্য হবেন না।