জুলাই-আগস্ট গণ অভ্যুত্থানের ঘটনায় শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় প্রসিকিউশনের চতুর্থ ও পঞ্চম সাক্ষী বর্ণনা দিয়েছেন শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে লক্ষ করে পুলিশের গুলি করার ঘটনার। বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ গতকাল সাক্ষ্য দেন রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ২৯ বছর বয়সি রিনা মুর্মু এবং এনটিভির রংপুরের সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ৫৮ বছর বয়সি এ কে এম মঈনুল হক।
এ মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়াও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন আসামি। হাসিনা ও কামাল পলাতক থাকলেও সাবেক পুলিশপ্রধান মামুন গ্রেপ্তার রয়েছেন। তিনি হয়েছেন রাজসাক্ষীও।
বিশ্ববিদ্যালয়টির তৎকালীন শিক্ষার্থী রিনা মুর্মু তার জবানবন্দিতে বলেন, চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে আবু সাঈদকে লক্ষ্য করে পুলিশের গুলি করার দৃশ্য নিজ চোখে দেখেছেন। এ হত্যাকাণ্ডের জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন, গুলি করা পুলিশ সদস্য এবং রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের তৎকালীন দায়িত্বরতদের দায়ী করে তাদের বিচার দাবি করেন তিনি। অন্যদিকে এনটিভির সাংবাদিক মঈনুল হক জবানবন্দিতে জানালেন ঘটনার সময় তিনি সরাসরি সম্প্রচারে ছিলেন। এ সময়ই ক্যামেরায় ধরা পড়ে আবু সাঈদকে পুলিশের গুলি করার দৃশ্য।
এ দুই সাক্ষীর জবানবন্দি শেষে তাদের জেরা করেন পলাতক থাকা শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। পরে এ মামলায় পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আগামী ১৭ আগস্ট দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল। এদিন প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম, গাজী এম এইচ তামীম, বি এম সুলতান মাহমুদ, আবদুস সাত্তার পালোয়ানসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। জবানবন্দিতে রিনা মুর্মু বলেন, ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই আমরা আন্দোলনের জন্য দুটি স্থান নির্ধারণ করি। এর একটি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর গেট ও আরেকটি লালবাগ। সকাল ১০টার দিকে রংপুর শহরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা জেলা স্কুলের সামনে একত্রিত হয়ে মিছিল নিয়ে প্রেস ক্লাবে এলে আমি সেখানে যোগ দিই। আমরা মিছিল নিয়ে চারতলা মোড়ে যাই। যাওয়ার পথে পুলিশি বাধার সম্মুখীন হই। সেখানে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও কারমাইকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা আমাদের সঙ্গে যোগ দেন। আমরা সবাই একসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর গেটে (বর্তমানে শহীদ আবু সাঈদ গেট) একত্রিত হই। সেখানে আগে থেকেই পুলিশ, ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের লোকজন অবস্থান করছিল। আমরা মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে গেলে পুলিশের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডা হয়। পুলিশ হঠাৎ করেই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠিচার্জ শুরু করে। টিয়ার শেলও নিক্ষেপ করে। এতে আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই।
রিনা মুর্মু বলেন, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর গেটের বিপরীত দিকে একটি চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে যাই। সে সময় আবু সাঈদকে পুলিশ ও ছাত্রলীগ লাঠি দিয়ে মারধর করে। আবু সাঈদ রাস্তার ডিভাইডারের একটু সামনে দাঁড়ান। তার দুই হাত প্রসারিত অবস্থায় ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর গেটে অবস্থানরত দুজন পুলিশ আবু সাঈদকে লক্ষ্য করে গুলি করে। এতে আবু সাঈদ পড়ে যান। আমাদের সহযোদ্ধা আয়ান আবু সাঈদকে উঠায়। পরে আরও কয়েকজন এসে তাকে পার্কের মোড়ের দিকে নিয়ে যাই। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেখান থেকে আবু সাঈদকে গুলি করার ঘটনা দেখেছি। পরে আমরা নিরাপদ স্থানে চলে যাই। এরপর আনুমানিক বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে জানতে পারি আবু সাঈদ মারা গেছেন। সাক্ষী রিনা মুর্মু বলেন, যে দুজন পুলিশ গুলি করেছিল তাদের নাম আমি পরে জানতে পারি। একজন পুলিশের নাম আমির আলী, আরেকজনের নাম সুজন চন্দ্র।
এনটিভির লাইভে ধরা পড়ে গুলির দৃশ্য : এনটিভির সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট হিসেবে রংপুরে কর্মরত এ কে এম মঈনুল হক আবু সাঈদকে পুলিশের গুলি করার দৃশ্যের বিষয়ে বর্ণনা দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেওয়া নিজের জবানবন্দিতে। তিনি বলেন, ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই দুপুর ২টার আগে থেকে আমি এবং আমার সহকর্মী ভিডিও জার্নালিস্ট আসাদুজ্জামান আরমান রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর গেটের সামনে পেশাগত দায়িত্ব পালন করছিলাম। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সেদিন রংপুর প্রেস ক্লাব এলাকা থেকে একটি মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর গেটের সামনে আসে। গেটে আগে থেকে অবস্থান নেওয়া পুলিশ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ এবং সরকারি দলের সমর্থকরা বাধা দেন। পুলিশের আশপাশে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারীকেও তাদের সঙ্গে দেখতে পাই।
জবানবন্দিতে সাংবাদিক মঈনুল বলেন, আন্দোলনকারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর গেটের সামনে একটি সমাবেশ করার চেষ্টা করে। দু-একজন কথা বলার চেষ্টা করে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে যেতে চায়। এ সময় পুলিশ এবং তাদের সঙ্গে যারা ছিল তারা বাধা দেয়। একপর্যায়ে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ লাঠিচার্জ শুরু করে। আন্দোলনকারীরা স্লোগান দিয়ে জমায়েত ধরে রাখার চেষ্টা করে। এ সময় পুলিশ টিয়ার শেল নিক্ষেপ, রাবার বুলেট ও শটগানের গুলিবর্ষণ শুরু করে। তখন দুপুর ২টা পার হয়ে গেছে। এনটিভির দুপুর ২টার খবরও শুরু হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, আমরা টিয়ার শেল, গুলিবর্ষণসহ সেখানকার ভীতিকর অবস্থার ভিডিও ফুটেজ এনটিভিতে প্রেরণ শুরু করি। সেই ভিডিও ফুটেজ দেখে এনটিভি কর্তৃপক্ষ আমাকে লাইভে যুক্ত হওয়ার নির্দেশ দেয়। দুপুর আনুমানিক ২টা ১৩ মিনিটের দিকে আমার সহকর্মী ভিডিও জার্নালিস্ট আসাদুজ্জামান আরমানসহ আমি লাইভে যুক্ত হয়ে সেখানকার সামগ্রিক পরিস্থিতি এনটিভির মাধ্যমে সারা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরি। দুপুর আনুমানিক ২টা ১৭ মিনিটের দিকে ১ নম্বর গেটের সামনে রোড ডিভাইডারের একটি ছোট কাটা অংশ দিয়ে এগিয়ে এসে কালো টি-শার্ট ও কালো প্যান্ট পরা এক যুবক রাস্তার ডিভাইডারের পাশে এসে দাঁড়িয়ে যায়। এ সময় সে দুই দিকে দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে পড়ে। সেখান থেকে মাত্র কয়েক গজের দূরত্বে ১ নম্বর গেটের সামনে অবস্থানরত পুলিশ এই যুবককে উদ্দেশ্য করে গুলি করে। এ দৃশ্য তখন এনটিভিতে লাইভ সম্প্রচার চলছিল।
তিনি আরও বলেন, পুলিশের গুলি এ যুবকের সামনের দিকে অর্থাৎ বুক ও পেটে লাগে। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর ওই যুবক কয়েক পা পিছিয়ে যান এবং বসে পড়েন। এ সময় তার অন্য সহযোগী কয়েকজন যুবক তাকে তুলে নিয়ে পার্কের মোড়ের দিকে নিয়ে যান। তিনি বলেন, যখন ওই যুবককে গুলি করা হয় ঠিক সে সময় ক্যামেরা ঘুরিয়ে ১ নম্বর গেটের সামন থেকে যে পুলিশরা গুলি করছিল তাদেরও এনটিভির লাইভে দেখায়। এরপর আমরা অন্য সহকর্মীদের মাধ্যমে ওই গুলিবিদ্ধ যুবককে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে জানতে পারি। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সূত্র থেকে জানতে পারি গুলিবিদ্ধ যুবক রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং তার নাম আবু সাঈদ। বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে আমরা জানতে পারি গুলিবিদ্ধ আবু সাঈদ মৃত্যুবরণ করেছেন।
আনুষ্ঠানিক বিচারকাজ শুরু : জুলাই অভ্যুত্থানে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যার ঘটনায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ৩০ জনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের আদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-২ গতকাল এ আদেশ দেন। একই সঙ্গে ২৭ আগস্ট এ মামলায় সূচনা বক্তব্য (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) ও সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্য দিয়ে এ মামলার আনুষ্ঠানিক বিচারকাজ শুরু হলো।
এ মামলায় ৩০ আসামির মধ্যে ২৪ জন পলাতক। গ্রেপ্তার ছয়জনকে গতকাল ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। তাঁরা হলেন সাবেক এএসআই আমির হোসেন, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) সাবেক প্রক্টর শরিফুল ইসলাম, কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায়, ছাত্রলীগ নেতা ইমরান চৌধুরী, রাফিউল হাসান রাসেল ও আনোয়ার পারভেজ। আদালতে প্রসিকিউশনের পক্ষে প্রসিকিউটর এস এম মইনুল করিম ও আসামিপক্ষে আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু উপস্থিত ছিলেন।
৩০ জুলাই প্রসিকিউশনের পক্ষে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম এ মামলায় অভিযোগ গঠনের আর্জি পেশ করে শুনানি করেন। ওই দিনই আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। এর আগে ২৪ জুন চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ে আবু সাঈদ হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। সেখানে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর শরিফুল ইসলামসহ ৩০ জনকে এ মামলায় আসামি করা হয়।
কোটা সংস্কার আন্দোলন কেন্দ্র করে ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই রংপুরে পুলিশের গুলিতে আবু সাঈদ নিহত হন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টির ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের কর্মসূচি চলাকালে আবু সাঈদকে পুলিশ গুলি করা হয়। সে দৃশ্য দেশের টিভি চ্যানেলগুলো সরাসরি সম্প্রচার করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে নিরস্ত্র আবু সাঈদের গুলিবিদ্ধ হওয়ার ভিডিও মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে। এতে সারা দেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় এবং ছাত্র-জনতা প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ হয় এবং জনসম্পৃক্ততা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়।