রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ীতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় সর্বশেষ খবর পর্যন্ত ৩১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে এক শিক্ষার্থীর মাসহ নিহত কয়েকজন শিশু শিক্ষার্থীকে তাদের নিজ নিজ গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়েছে। এ সময় স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে আশপাশের পরিবেশ। দুর্ঘটনায় নিহত কয়েকজনের গ্রামের বাড়িতে দাফন নিয়ে আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো প্রতিবেদন :
ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন থেমে গেল আনিশার : বিমান দুর্ঘটনায় নিহত ফাতেমা আক্তার আনিশার (৯) ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন ছিল। মাইলস্টোনের বাংলা ভার্সনের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী ছিল সে। গতকাল ভোরে বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার কুনিয়া গ্রামের বাড়িতে আনিশার লাশবাহী ফ্রিজিং ভ্যানটি এসে পৌঁছালে তার স্বজনরা আহাজারি করতে থাকেন। আনিশা বাগেরহাট উপজেলার কলাতলা ইউনিয়নের কুনিয়া গ্রামের কুয়েত প্রবাসী বনি আমিন ও রোপা দম্পতির বড় মেয়ে ছিল। দুর্ঘটনায় মেয়ের আহত হওয়ার খবর পেয়ে বাবা বনি আমিন শেখ কুয়েত থেকে ঘটনার দিন রাতেই দেশে ফেরেন। ঢাকায় ফিরেই জানতে পারেন তার মেয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছে। নিহত ফাতেমার মামা স্বপন মীর কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার ভাগনির ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন ছিল। দুর্ঘটনার পর আমি ও বোন বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজাখুঁজি করেছি। পরে একটি হাসপাতালে গিয়ে দেখি তার নিথর লাশ পড়ে রয়েছে।’ আনিশা তিন ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় ছিল বলেও জানান তিনি। গতকাল সকাল ১০টায় কুনিয়া মাদরাসা-সংলগ্ন কবরস্থানে জানাজা শেষে আনিশার দাফন সম্পন্ন হয়।
মেয়েকে আনতে গিয়ে নিহত রজনী ইসলামের দাফন সম্পন্ন : রজনী ইসলামের (৪৫) দাফন সম্পন্ন হয়েছে। গতকাল সকাল ১০টায় কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার হোগলবাড়িয়া ইউনিয়নের সাদিপুর গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। এর আগে সকাল ৯টায় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। উল্লেখ্য, রজনী ইসলাম মাইলস্টোন স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী ঝুমঝুমের মা। দুর্ঘটনার পর মেয়েকে খুঁজতে গিয়ে আহত হন তিনি। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সিএমএইচে তার মৃত্যু হয়। নিহত রজনী ইসলাম সাদিপুর গ্রামের বাসিন্দা জহুরুল ইসলামের স্ত্রী। দুই ছেলে ও এক মেয়ের জননী রজনী রাজধানীর উত্তরায় সপরিবারে বসবাস করতেন। মাকে হারালেও সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছে ঝুমঝুম।
সায়ানের লক্ষ্মীপুরের বাড়িতে শোকের মাতম : সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সায়ান ইউসুফ (১৪) ঘটনার দিন গভীর রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। পরে গতকাল বিকালে লক্ষ্মীপুরের বশিকপুরের গ্রামের বাড়িতে জানাজা শেষে সায়ানের দাফন সম্পন্ন হয়। তার বাবা এ এফ এম ইউসুফ মাইলস্টোন কলেজ শাখার রসায়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও মা শামীমা শাম্মী মাইলস্টোন স্কুল শাখার রসায়নের শিক্ষক। তারা উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টরে ভাড়া থাকেন। একই ঘটনায় সদর উপজেলার পার্বতীনগর ইউনিয়ন সোনাপুর গ্রামের রহিমবক্স হাজিবাড়ির আবদুস সামাদের ছেলে আফনান ফায়াজও মারা যায়। তাকে গতকাল সকালে ঢাকায় দাফন করা হয়েছে। আফনানও সপ্তম শ্রেণির ছাত্র ছিল।
আবদুল্লাহ ছামীমের (১৩) দাফন : আবদুল্লাহ ছামীমের (১৩) দাফন সম্পন্ন হয়েছে। গতকাল সকাল ৯টায় শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার সখিপুরের ডিএমখালী চরভয়রা উচ্চবিদ্যালয় মাঠে জানাজার পর পারিবারিক কবরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন হয়। ছামীম সখিপুর থানার ডিএমখালী ইউনিয়নের বাসিন্দা মৃত আবুল কালাম মাঝির ছোট ছেলে। সে প্রতিষ্ঠানটির ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র ছিল। উল্লেখ্য, ঘটনার দিন রাত সাড়ে ১০টায় জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ডাক্তাররা ছামীমকে মৃত ঘোষণা করেন।
দুই শিক্ষার্থীর দাফন টাঙ্গাইলে : টাঙ্গাইলের দুই শিক্ষার্থী তৃতীয় শ্রেণির মেহেনাজ আক্তার হুমাইরা (৮) ও অষ্টম শ্রেণির তানবীর আহমেদের (১৪) দাফন সম্পন্ন হয়েছে। গতকাল সকালে তাদের নিজ নিজ এলাকায় জানাজা শেষে স্থানীয় সামাজিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। হুমাইরা সখীপুর উপজেলার হতেয়া কেরানিপাড়া গ্রামের দেলোয়ার হোসেনের মেয়ে। তার বাবা মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক। আর তানবীর আহমেদের টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে গ্রামের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। দুই ভাইয়ের মধ্যে তানবীর ছিল সবার বড়। তানবীর উপজেলার ওয়ার্শি ইউনিয়নের নগরভাতগ্রাম গ্রামের রুবেল মিয়ার ছেলে। তানবীরের ছোট ভাই তাশরীফও একই স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে।
শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী গ্রামে চিরশায়িত শিক্ষিকা মাসুকা বেগম : মৃত্যুর আগে বলে যাওয়া শেষ ইচ্ছা (অসিয়ত) অনুযায়ী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে আপন বোনের বাড়ির এলাকার কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন মাইলস্টোনের শিক্ষিকা মাসুকা বেগম (নিপু)। গতকাল বাদ আসর সোহাগপুর ঈদগাহ মাঠে জানাজা শেষে ওই গ্রামের প্রধান কবরস্থনে তার লাশ দাফন করা হয়। তিনি ওই স্কুলের প্রাইমারি শাখার ইংরেজি মাধ্যমের ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষিকা ছিলেন। জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে তার মৃত্যু হয়।
বরিশালে নানার পাশে সমাহিত সামীর : বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলায় নানা কবরের পাশে দাফন করা হয়েছে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্র মোহাম্মদ সামীউল করিম সামীরকে (১১)। গতকাল সকাল ১০টায় উপজেলার চাঁনপুর ইউনিয়নের খোন্তকালী গ্রামের বাসিন্দা প্রয়াত নানা বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা কামাল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠে জানাজা শেষে তার লাশ দাফন করা হয়। সামীর মেহেন্দিগঞ্জ পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মো. রেজাউল করীম শামীমের ছেলে। তার মা রেশমা করিম বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা কামাল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা। বাবা উত্তরায় বায়িং হাউস ব্যবসা করেন।
গাজীপুরে শায়িত সায়মা : মেয়ে সায়মাকে চিকিৎসক বানানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন বাবা-মা। তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী সায়মাকে নিয়ে সে স্বপ্ন গতকাল ভেঙে গেছে। আর একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন নিহতের বাবা-মা। সায়মার বাবা শাহ আলম একটি বেসরকারি কোম্পানিতে মার্কেটিং ম্যানেজার হিসেবে চাকরি করেন। থাকেন রাজধানীর উত্তরায়। সায়মার বাবা শাহ আলম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার মেয়ের স্বপ্ন ছিল সে ডাক্তার হবে। এখন তো সব শেষ।’ এজন্য কাউকে দায়ী না করে তিনি বলেন, ‘আমার কপালে নেই।’ সোমবার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে লাশবাহী গাড়িতে সায়মার নিথর দেহ পৌঁছে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ২১ নম্বর ওয়ার্ডের বিপ্রবর্থা এলাকায়। পরে গতকাল সকাল ১১টার দিকে নিহতের নামাজে জানাজা শেষে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।