চোখের সামনে ভাসছে মাইলস্টোন স্কুলের নিষ্পাপ শিশুগুলোর মুখ। চারপাশে আর্তনাদ, আহাজারি, কান্না আর শোকের মাতম। সন্তান হারানো মাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা সম্ভবত কারও জানা নেই। সারা দেশ শোকে স্তব্ধ। এমনিতেই চারপাশে শঙ্কা, হতাশা, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, এর মধ্যে স্কুলে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনা যেন বাংলাদেশের শোকের ষোলোকলা পূর্ণ করেছে। এ সময়ে সেনাবাহিনীর উদ্ধার তৎপরতা ছিল আশাজাগানিয়া। যেভাবে তারা উদ্ধারকাজে সর্বোচ্চ ত্যাগ এবং সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে তা সত্যি প্রশংসনীয়। সেনাবাহিনীর ভূমিকা যেমন জাতির জন্য দৃষ্টান্ত ঠিক তেমনি এ ঘটনার পর রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণ যেন উদ্বেগের। রাজনৈতিক নেতারা শোক জানাতে হাসপাতালে যেভাবে ভিড় করেছেন, তা ছিল রীতিমতো দৃষ্টিকটু। এ শোকের মধ্যেও তারা বিবাদে জড়িয়েছেন। কে বেশি সহানুভূতিশীল তা প্রমাণে মারামারিও করেছে। অনাদিকাল থেকে আমরা দেখেছি শোকে, সংকটে বাংলাদেশের জনগণ একাত্ম হয়ে যায়। একে অন্যের পাশে দাঁড়ায়। বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে সংকট মোকাবিলা করে। আমরা কী আমাদের চিরায়ত ঐতিহ্য ও অহংকারের সংস্কৃতিও হারাতে বসেছি?
মাইলস্টোনে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনা এমন একসময় ঘটল যখন জুলাই বিপ্লবের বর্ষপূর্তির দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ। এ সময় পেছনে ফিরে তাকালে শুধু হতাশার চিত্র। মাইলস্টোনের ঘটনা যেন সেই হতাশাকে পূর্ণতা দিল। আমাদের চারপাশে কোথাও যেন কোনো সুখবর নেই। চারদিকে শুধু অনিশ্চয়তা, উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ। আমরা কোথায় যাচ্ছি? কী হচ্ছে? দেশের ভবিষ্যৎ কোন পথে? সর্বত্র এসব প্রশ্ন যেন মানুষের মুখে মুখে। কিন্তু এসব কোনো প্রশ্নের উত্তর নেই।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার আসলে কী করতে চাচ্ছে? দেশ কোন পথে যাচ্ছে? এ নিয়ে মানুষের ভাবনার মধ্যে অনিশ্চয়তা আর উৎকণ্ঠার চিত্র সুস্পষ্ট। সবাই আশা করেছিল অন্তর্বর্তী সরকার আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন দেবে এবং একটি গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করে দেশের বিদ্যমান সংকটগুলো সমাধানের জন্য কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত যে পরিস্থিতি তাতে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আদৌ হবে কিনা তা নিয়ে বেশির ভাগ মানুষ সন্দিহান।
রাজনীতি এখন কুৎসিত নোংরামিতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। পেশিশক্তি, বলপ্রয়োগ, মব সন্ত্রাস, ধমক দেওয়া ইত্যাদি যেন এখন রাজনীতির একটি নতুন সংস্কৃতির সৃষ্টি করেছে। কুৎসিত স্লোগান এবং কুৎসিত ভাষা প্রয়োগ রাজনীতিকে কলুষিত করছে প্রতিনিয়ত। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের অসহিষ্ণুতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশেষ করে অনিবন্ধিত সদ্য গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি সারা দেশে যেভাবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করছে, তাতে সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়েও বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যেন রাজনৈতিক দলগুলোকে বিভক্ত করার এক মিশনে নেমেছে। এমন সব বিষয় নিয়ে এখন আলোচনা হচ্ছে যে বিষয়গুলো নিয়ে নির্বাচনের পরও আলোচনা হতে পারে। সংসদে উচ্চকক্ষ কী রকম হবে? তত্ত্বাবধায়ক সরকার কাঠামো কেমন হবে? প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা এবং দলীয় প্রধান একসঙ্গে থাকতে পারবেন কি না, পিআর পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয় এখন মোটেও গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ এসব কোনো সিদ্ধান্তই জাতীয় সংসদ ছাড়া কার্যকর হতে পারবে না। সংবিধান সংশোধন বা সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তন করতে গেলে একটি নির্বাচিত জাতীয় সংসদ লাগবেই। কাজেই এ ধরনের তাত্ত্বিক আলোচনা করে কেবলমাত্র রাজনৈতিক দলগুলো একে অন্যকে আক্রমণ করতে পারবে, কাদাছোড়াছুড়ি করতে পারবে। জুলাই বিপ্লবের শক্তির মধ্যে সৃষ্টি হবে বিভক্তি। এতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সন্দেহ অবিশ্বাস বাড়বে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হবে না। তাহলে কি কেউ ইচ্ছে করেই করছে এসব?
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে। কাজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাঠামো বা অবয়ব কী রকম হবে, সংসদ দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট হবে, না এক কক্ষ বিশিষ্ট হবে, দলীয় প্রধান কি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন, না পারবেন না ইত্যাদি নতুন সংসদের বিষয়। এ সাংবিধানিক বিষয়গুলোর জন্য প্রয়োজন সংবিধান সংশোধন। সংবিধান সংশোধন এ অন্তর্বর্তী সরকার করতে পারবে না। অন্তর্বর্তী সরকার যেটা করতে পারবে, সেটি হলো একটি নির্বাচন দেবে এবং নির্বাচনে যারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে, তারা সবার সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়গুলো নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম। কারণ সংসদ নির্বাচনে যারা নির্বাচিত হবেন, তারা সত্যিকারের জনপ্রতিনিধি। আর এ ধরনের মৌলিক বিষয় সংস্কার করা, পরিবর্তন করার এক্তিয়ার শুধু দেশের জনগণের। জনগণের প্রতিনিধি হিসাবে সংসদ সদস্যদের। সুশীল সমাজের কয়েকজন প্রতিনিধির চিন্তাপ্রসূত ধারণা থেকে আমরা সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তন করতে পারি না। এটি সুশীলদের বিষয় হতে পারে কিন্তু এর সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক কতটুকু তা ঠিক করবে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা।
রাজনীতির অবস্থা যেমন অনিশ্চয়তার ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত, ঠিক তেমনি অন্ধকারে যেন হাতড়ে বেড়াচ্ছে দেশের অর্থনীতি। অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় ধাক্কার অপেক্ষায় আছি আমরা। যে সময় অন্তর্বর্তী সরকার তার প্রথম বছর পূর্ণ করবে, সেই সময় থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর ৩০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করবে। এ শুল্ক আরোপ ইস্যু নিয়ে সরকার এক ধরনের ভাবলেশহীন এবং উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছে। একটি দায়িত্বশীল সরকারের কাছ থেকে কেউ এ ধরনের আচরণ প্রত্যাশা করেনি। কারণ ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ৩৭ শতাংশ করেছিল, তখন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে শুধু প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস একটি চিঠি লিখেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। সেই সময় চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে তিন মাসের জন্য এ শুল্ক স্থগিত করা হয়েছিল। এতেই আমরা খুশিতে আত্মহারা হয়েছি। পরবর্তী করণীয় নিয়ে কাজ করিনি। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে রপ্তানিকারক ব্যবসায়ী এবং শিল্প উদ্যোক্তাদের যুক্ত করা হয়নি। তাদের নিয়ে আসন্ন সংকট মোকাবিলায় কোনো আলোচনাও করেনি সরকার। বরং আমরা সবকিছু ছেড়ে দিয়েছি প্রধান উপদেষ্টার ওপর। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খুব ভালো সম্পর্ক। কাজেই তিনি একাই এ বিষয়টি সমাধান করবেন। কিন্তু মার্কিন কূটনীতি সম্বন্ধে যাদের ন্যূনতম ধারণা আছে, তারা জানেন যে এখানে একক ব্যক্তির ইমেজ বা কথায় কোনো কিছু হয় না। এখানে দরকার ছিল বহুমাত্রিক অর্থনৈতিক কূটনীতি। লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ ছিল জরুরি। এখন যখন শুল্ক আরোপের ক্ষণগণনা শুরু হয়েছে, সেই সময় সরকার ব্যবসায়ীদের দ্বারস্থ হয়েছে এবং তাদের বলছে লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ করার জন্য। কিন্তু এ অল্প সময়ের মধ্যে লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ করা প্রায় অসাধ্য একটি ব্যাপার। তা ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির দপ্তর (ইউএসটিআর) সরকারের সঙ্গে যে আলাপ-আলোচনা করছে, তাতে তারা সরাসরি জানিয়ে দিয়েছে এটা হোয়াইট হাউসের বিষয়। কারণ মার্কিন প্রেসিডেন্টের নির্বাহী আদেশ বলে এ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এ বাড়তি শুল্ক আরোপ যদি বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর আরোপ করা হয়, তাহলে চোখ বন্ধ করে বলা যায় যে আমাদের পোশাকশিল্প খাতে একটা ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হবে। বহু পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। সঙ্গে সঙ্গে বেকার হবে বহু মানুষ। এর ফলে সার্বিক অর্থনীতিতে একটি ভয়ংকর সংকট দেখা দেবে। বাংলাদেশ একটা মহামন্দার দিকে ধাবিত হবে। আর এ রকম পরিস্থিতি যদি তৈরি হয় তাহলে সেই পরিস্থিতি থেকে আমাদের উদ্ধারের কোনো পথ নেই।
গত রবিবার ব্যবসায়ী নেতারা এক গোলটেবিল বৈঠকে বলেছেন, তাদের ৪০ বছর রপ্তানিতে এমন সংকট দেখা যায়নি। যথার্থই তারা এ কথাটি বলেছেন। এ সংকট সৃষ্টি হওয়ার পেছনে সরকারের উদাসীনতা, অতি আত্মবিশ্বাসকেই দায়ী করছেন অনেকে। এমনিতেই অর্থনীতির অবস্থা খারাপ। বহু শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে আছে। অনেক শিল্প উদ্যোক্তার বিরুদ্ধে দমন নীতি গ্রহণ করেছে সরকার। বাংলাদেশের বড় বড় কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে। নানারকমভাবে তাদের হয়রানি করা হচ্ছে। ফলে ব্যবসায়ীরা এখন হাত পা গুটিয়ে বসে আছেন। তার মধ্যে যদি পোশাক খাতের এ বিপর্যয় আসে, তাহলে বাংলাদেশ একটি ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়বে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে যেমন সুখবর নেই, সুখবর নেই অর্থনীতিতে, তেমনি রাজনৈতিক অঙ্গনেও সুখবর নেই। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবস্থাও ভালো নয়। এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। ঢাকাসহ সারা দেশে ছিনতাই, রাহাজানি, খুন, মব সন্ত্রাস এখন এখনো চলছে প্রতিনিয়ত। মানুষ চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এ নিরাপত্তাহীনতা থেকে তাদের মুক্তির পথ কী সেটিও তারা জানেন না। সবকিছু মিলিয়ে গত এক বছরে মানুষ যে প্রত্যাশার বেলুন ফুলিয়েছিল, সেই বেলুন যেন চুপসে গেছে। বাংলাদেশ যেন যাচ্ছে এক অজানা গন্তব্যের দিকে। আমাদের এ অনিশ্চয়তার শেষ কোথায় সেটি যেন মানুষের কাছে প্রশ্ন। এ দেশের মানুষ এক বুক আশা নিয়ে রাজপথে নেমেছিল, স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছিল কিন্তু সেই আশা এখন দীর্ঘ শ্বাসে রূপান্তরিত হচ্ছে। এদেশের মানুষ জানে না এ দেশের গন্তব্য কোথায়?
মাইলস্টোনে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা একটি বেদনাদায়ক দুর্ঘটনা। গোটা দেশে যেন এ রকম বিপর্যয় নেমে না আসে, সে ব্যাপারে আমাদের সতর্ক হতে হবে। না হলে মহাদুর্যোগে আমরাও বিপর্যস্ত হবো মাইলস্টোনের অসহায় নিষ্পাপ শিক্ষার্থীদের মতো।