প্রধানমন্ত্রী হতে হলে দলীয় প্রধানের পদ ছেড়ে আসতে হবে। বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর আপত্তি সত্ত্বেও এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। ফলে একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধানের পদে থাকতে পারবেন না। তবে এ সিদ্ধান্তে জাতীয় সনদে কোনো দল চাইলে নোট অব ডিসেন্ট দিতে পারবে বলে জানিয়েছে কমিশন। এ ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন কাঠামো নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হলেও একমত হতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো। সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি কমিশনও। এ বিষয়ে পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত জানানো হবে বলে জানিয়েছে কমিশন।
গতকাল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় দফার সংলাপ শেষে এসব তথ্য জানানো হয়। সংলাপের শুরুতে উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান দুর্ঘটনার ওপর একটি শোক প্রস্তাব গৃহীত হয়। শোক প্রস্তাবটি পাঠ করেন কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার। দ্বিতীয় দফার সংলাপের ১৭তম দিনে সভাপতিত্ব করেন ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের সঞ্চালনায় সংলাপে অংশ নেন কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন ও ড. মো. আইয়ুব মিয়াসহ ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা। গতকালের আলোচ্যসূচিতে প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, রাজনৈতিক দলের প্রস্তাবের ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে একটি সমন্বিত প্রস্তাব তৈরিসহ নির্বাচন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল, দুর্নীতি দমন কমিশন ও ন্যায়পাল নিয়োগ-সংক্রান্ত বিধিমালা অন্তর্ভুক্ত ছিল। সংলাপ শেষে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, প্রধানমন্ত্রী পদে দলীয় প্রধান থাকতে পারবেন না বলে একমত হয়েছে প্রায় তিন-চতুর্থাংশ রাজনৈতিক দল ও জোট। কিছু দল এ বিষয়ে ভিন্নমত ব্যক্ত করেছে। ওইসব দল জাতীয় সনদে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিতে পারবেন। যারা নোট অব ডিসেন্ট দিতে উৎসাহী, যদি আপনারা প্রয়োজন মনে করেন সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে পারেন। এটা সিদ্ধান্ত হিসেবে আপনাদের জানালাম। জানা যায়, একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী, সংসদ প্রধান ও দলীয় প্রধান হতে পারবেন না- কমিশনের এমন প্রস্তাবের সঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সমর্থন জানালেও এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বিএনপিসহ কয়েকটি দল। সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা একজন হতে পারলেও তাকে দলীয় প্রধানের পদ ছাড়তে হবে এমন প্রস্তাব নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়। সেখানে বিএনপি, এলডিপি, লেবার পার্টি, এনডিএম, ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট এবং আম জনতার দল ওই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। তবে দলীয় প্রধানকে প্রধানমন্ত্রী করার বিপক্ষে মত দেন জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ অন্য দলগুলো। সর্বশেষ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব কমিশনের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। এদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন কাঠামোর নানা ইস্যুতে দীর্ঘ আলোচনা হলেও একমত হতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো। সংলাপে জাতীয় সংসদের স্পিকারের নেতৃত্বে গঠিত বাছাই কমিটির মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা নিয়োগের প্রস্তাব করে কমিশন। কমিটির বিষয়ে দলগুলো একমতও ছিল। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে সংশোধিত প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ জানান, কমিটির মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ না করা গেলে সংবিধানের ১৩তম সংশোধনীর বিধান বলবৎ হবে। তবে সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকে বাদ রাখা হবে। অর্থাৎ কোনোভাবেই রাষ্ট্রপতি প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিতে পারবেন না। ১৩তম সংশোধনীতে বিচার বিভাগ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের কথা বলা আছে। এই ইস্যুতে বিএনপি ও জামায়াত একমত হয়েছে। তবে এনসিপিসহ অন্যান্য দলগুলো আপত্তি জানানোর পাশাপাশি বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছে। এতে সরকারি ও বেসরকারি দলের পাশাপাশি সংসদের অন্যান্য দল, এমনকি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোকে সার্চ কমিটির সদস্য প্রস্তাবের ক্ষমতা প্রদানের বিধান রাখার সুপারিশ করা হয়। ফলে সিদ্ধান্ত ছাড়াই আলোচনা শেষ হয়েছে। সংলাপ শেষে গণসংহতি আন্দোলনের নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান রুবেল বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন ও কারা এই সরকারের প্রধান হবেন সেই ইস্যুতে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী একমত হয়ে যাওয়ার কারণে অন্য দলের নতুন প্রস্তাব চাপা পড়ে গেছে। এদিকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে সংশোধিত প্রস্তাব জমা দিয়েছে বিএনপি। ওই প্রস্তাবে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগে থাকবে চার সদস্যের বাছাই কমিটি। তারা হলেন- প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার (বিরোধী দলের)। কমিটির যে কোনো বৈঠক ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সভাপতিত্ব করবেন স্পিকার। উপদেষ্টা থাকবেন ১৫ জন। গতকাল কমিশনের বৈঠকে নতুন ওই সংশোধিত প্রস্তাব লিখিত আকারে দেওয়া হয়।
এর আগে সোমবার গভীর রাতে বিষয়টি নিয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানান দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। বিএনপির সংশোধিত প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৩০ দিন আগে জাতীয় সংসদের স্পিকারের তত্ত্বাবধানে এবং সংসদ সচিবালয়ের ব্যবস্থাপনায় চার সদস্য বিশিষ্ট নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের জন্য বাছাই কমিটি গঠন করা হবে। সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার ১৫ দিন আগে এবং মেয়াদ শেষ ছাড়া অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে গেলে পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের বিষয়টি চূড়ান্ত করতে হবে। এতে বলা হয়েছে, কমিটি গঠিত হওয়ার পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দল এবং জাতীয় সংসদের স্বতন্ত্র সদস্যদের কাছ থেকে সংবিধানের ৫৮-গ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তির নাম প্রস্তাবের আহ্বান করবেন এবং এ ক্ষেত্রে একটি দল একজন এবং একজন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য একজন মাত্র ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করতে পারবেন।
বিমান দুর্ঘটনায় শোক প্রস্তাব : ঐকমত্য কমিশনের গৃহীত শোক প্রস্তাবে বিমান দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে যথাযথ তদন্ত এবং এ ধরনের দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যও সরকারের প্রতি দাবি জানানো হয়। একই সঙ্গে সরকারের প্রতি নিহত ও আহতদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ ও ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানানো হয়।