প্রচারেই প্রসার। কথাটি ষোলো আনা খাঁটি বলে যাঁরা মানেন তাঁদের কারণেই নাকি বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলো খেয়ে-পরে বেঁচে বর্তে রয়েছে। গণমাধ্যম? বিজ্ঞাপনী সংস্থার এক বাঘা কর্মকর্তা, যাঁকে আমরা ‘সানাভাই’ সম্বোধন করতাম, একবার মধ্যাহ্নভোজ-উত্তর বকবকানির আসরে বলেন, অ্যাড ফার্ম তোমরার খোরাকি জোগায়। নইলে তোমরা মিডিয়াঅলারা কত্ত আগে হাওয়া হয়া যাইতা!
মনে পুষে রাখা ক্ষোভ উগরে দেওয়ার পর্যায়ে সুজাত আলী সানা দার্শনিক হয়ে যেতেন এবং ‘ডিম হাওয়া হয়া গেলে মুরগা ক্যামতে পাইতা!’ ধরনের বাণী দিতেন। রাজধানীর বংশাল রোডের যে পত্রিকা অফিসে আমি কাজ করতাম তার বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠানে তাঁকে দাওয়াত না করায় তিনি অপমানবোধ করেছিলেন। করারই কথা। কেননা বস্কে বুঝিয়ে-সুজিয়ে তিনিই দৈনিকটিকে ঘন ঘন অ্যাড পাইয়ে দিতেন।
সাময়িকী পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক গোলাম কিবরিয়া বলেন, দুনিয়ার সবার খোরাকি জোগাচ্ছেন আল্লাহ। অথচ আপনি অ্যাড ফার্মরে শিরোধার্য করতেছেন। এটা অন্যায়। ইন ফ্যাক্ট ইটস আ ক্লিয়ার কাট গুনাহ!
‘গুনাহ তো তুমিও করে ফেলেছ হে পীরজাদা!’ বলেন সানাভাই, ‘আমার টাকায় লাঞ্চ করেছ। যত টাকার খেয়েছ সেই টাকা ফেরত দিয়ে সাচ্চা ইমানি হওয়ার পথ অবশ্য তোমার জন্য এখনো খোলা আছে।’
পীর এনায়েতপুরীর বংশজাত কিবরিয়া। তাই মওকা মতো তাঁকে ‘পীরজাদা’ বলতেন সুজাত আলী সানা। স্বৈরশাসক ফিল্ড মার্শাল আইউব খানের মন্ত্রী ছিলেন সানাভাইয়ের এক চাচা। একাত্তরে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর তরক্কির জন্য এই চাচা নিজের জান উজাড় করতে প্রস্তুত ছিলেন। তাই গোলাম কিবরিয়া মধুময় ঝগড়ার সময়ে সানাভাইকে ‘গাদ্দার খান্দান কি খাজানা’ বলে মজা পেতেন। সানাভাই বলতেন, গোলামের ব্যবহার কত জঘন্য দেখ্লা?
মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার যে রেস্তোরাঁয় বহু দিন আমরা জোরপূর্বক সানাভাইয়ের অতিথি হয়ে ভুনা খিচুড়ি খেয়েছি, প্রায় আঠারো বছর ওখানে ঢুকি না। রেস্তোরাঁর নামফলক দেখামাত্র বুকটা টনটন করে ওঠে। বয়সে আমার ১০ বছরের ছোট কিবরিয়াকে ২০১০ সালে শেষ করে দিয়েছে কিডনির বৈকল্য। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাড়ির ড্রয়িংরুমে বসে টিভি পর্দায় ফিল্ম দেখছিলেন সুজাত আলী সানা। ওই সময় হিমশীতল ছোঁয়ায় হৃদ্যন্ত্র নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। দিব্যবৃক্ষের ছায়াতলে চলে গেলেন তিনি।
মৃত্যুর পর প্রাণ কোথায় যায়? গ্রিক পুরাণে আছে প্রতিটি প্রাণের জন্য পরলোকে সুনির্দিষ্ট গাছ থাকে। বীজ থেকে অংকুরিত হয়ে ক্রমশ ওপরের দিকে উঠতে হয় না। দৈবশক্তি শুরুতেই পরিপূর্ণ গাছ বানায়। সেই গাছের ছায়াতলে এনে রাখা হয় প্রাণ। সুজাত আলী সানার মতে, প্রতিটি মানুষই ওই দিব্যবৃক্ষের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণে বাধ্য। তিনি বলতেন : তবে যাওয়া বিলম্বিত করবার সাধনা চলমান রয়েছে। আয়ু বাড়ানোর অব্যাহত চেষ্টাও চারদিকে। আবার আছে নিত্যনতুন প্রাণসংহারী ব্যাধি। পাল্লা দিয়ে কোমর বেঁধে ‘খাই খাই’ প্রতিযোগ? না, তা যেন থামবার নয়।
২. আত্মকেন্দ্রিকতায় অন্ধজনরা সমাজকল্যাণী কাজে আগ্রহী হয় না। সাধকরা বলেন, তারা চেষ্টা করলেও কল্যাণকর কিছু করতে পারে না। কারণ পরওয়ারদেগার তাদের কাল্ব তালাবদ্ধ করে দিয়েছেন। বন্দি থাকতে থাকতে তাদের কাল্ব তিমিরাচ্ছন্ন হয়ে গেছে। সেজন্য তারা নিজকল্যাণে উতলা। এতটাই উতলা যে আশপাশের মানুষের জীবন অতিষ্ঠ করে দিয়ে নিজেকে উন্নত করতে চায়। তারা খুবই দুর্ভাগা। এ ধরনের উন্নয়ন যে অধগমনেরই নামান্তর তা-ও তাদের কেউ বুঝিয়ে বলবার গরজবোধ করে না।
আত্মকেন্দ্রিকতায় অভিশপ্ত ব্যক্তিদের দিব্য আলোয় অন্ধকারমুক্ত করার সাধনায় যাঁরা জীবন উৎসর্গ করেন, ইতিহাস তাঁদের নাম সযত্নে রক্ষা করে চলেছে। এবং সেটা কত চমৎকার হতে পারে, তা ভারতের রাজধানী দিল্লি নগরীতে গেলে বোঝা যায়। সুলতানি আমলে দিল্লিতে গিয়াসপুর নামে একটি জায়গা ছিল। জায়গাটি এখনো আছে। কিন্তু দিল্লি রেলস্টেশনে নেমে যদি বলেন, ‘গিয়াসপুর যাব’। ট্যাক্সি বা অটোরিকশা চালক ‘হা’ হয়ে যাবে। ওরকম জায়গা তাদের অজানা। যাত্রীকে বলতে হবে ‘নিজামুদ্দিন যাব।’
সুফিসাধক হজরত খাজা নিজামুদ্দিনের দরগাহ এই গিয়াসপুরে। অনেক আগে গিয়াসপুরকে ‘মেহরৌলি’ বলা হতো। এখানকার মাটিতে চিরনিদ্রায় শায়িত খাজা নিজামুদ্দিন। তিনি প্রচার করতেন, যাঁর অন্তর পরিচ্ছন্ন (সাফ) তাঁর দ্বারাই পরিচ্ছন্ন লোকালয় গড়ে তোলা সম্ভব। স্রষ্টা আমাদের জীবন দিয়েছেন সৃষ্টের সেবায় নিবেদিত হওয়ার জন্য। নিজেকে নিয়ে সর্বক্ষণ ব্যস্ততা ওই নিবেদনের স্পৃহা বিনষ্ট করে। পরাক্রম, ঐশ্বর্য, বিলাসিতা, ক্ষমতার আস্ফালন পরিহার করে আল্লাহপ্রেমে ব্রতী হতে হবে। যার কাল্ব (অন্তর) আল্লাহপ্রেমে ভরপুর, তাঁর কাল্ব মানবপ্রেমেও হয় ভরপুর।
খাজা নিজামুদ্দিনের জীবনকালে দিল্লিতে পরপর সাতজন সুলতান ক্ষমতাসীন ছিলেন। কয়েকজন সুলতান ছিলেন খাজার অনুরাগী, কয়েকজন ছিলেন বৈরী, খাজাকে যাঁরা অপদস্থ করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন। ধর্ম ব্যবসায়ী মোল্লারা খাজা নিজামুদ্দিনকে পছন্দ করতেন না। তাঁরা সুলতান গিয়াস উদ্দিন বলবনকে বলেন, ‘হুজুর! দরবেশ নিজাম আপনাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বয়ান দেন। তাঁকে সাজা দিন।’
সুলতানের দরবারে তলব করা হলো খাজাকে। অভিযোগ শোনার পর খাজা নিজামুদ্দিন একটি গল্প বলেন। গল্পে আছে-প্রেমিক পায়রা বলছে, ‘ধরা দাও প্রিয়ে।’ প্রেমিক পায়রা বলছে, ‘না। কখনো না।’ তখন প্রেমিক পায়রা বলে, ‘ধরা দাও বলছি। নইলে আমি বাদশাহ সোলেমানের সিংহাসন ওলটপালট করে ফেলব।’ প্রেমিক পায়রাকে তলব করেন সোলেমান। পায়রা বলে, ‘আবেগে কাতর প্রেমিক-প্রেমিকা যেসব কথা বলে তাকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ কি বাদশাহকে শোভা পায়?’
‘পায়রার ব্যাখ্যায় বাদশাহ সোলেমান সন্তুষ্ট হয়েছিলেন’ বলেন খাজা নিজামুদ্দিন, ‘আশা করি, সুলতান নামদার আমার ব্যাখ্যাও বুঝেছেন।’ জবাবে গিয়াসউদ্দিন বলবনের ঘোষণা : নিজাম দরবেশের বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগ নাকচ করা হলো।
৩. খাজা নিজামুদ্দিনের দরগাহ দেখেছিলাম ২০১৮ সালে। সেখানে এই মহান সুফিসাধকের চারিত্রিক দৃঢ়তা বিষয়ে নানাবিধ কাহিনি শোনা যায়। তার মধ্যে একটি হচ্ছে বিখ্যাত ‘দিল্লি হনুজ দূর অস্ত’ (দিল্লি এখনো অনেক দূরে)। আরও দুটি কাহিনি চমকপ্রদ। একটি ‘আল্লাহ’ নামের বরকত সম্পর্কীয়, অন্যটি জাগতিক ঐশ্বর্যের প্রতি প্রবল বিতৃষ্ণা।
সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির মৃত্যুর পর তাঁর সেনাপতি মালিক কাফুর গায়ের জোরে সিংহাসনে বসেন। প্রাসাদরক্ষীরা তাঁকে হত্যা করে। তখন সুলতান হলেন কুতুবউদ্দিন মুবারক শাহ। ইনি দরবেশ নিজামকে বাঁকা চোখে দেখতেন। ক্ষমতাসীন হওয়ার পর কুতুবউদ্দিন গুজরাটি বালক খসরু খানের সঙ্গে সমকামী সম্পর্ক গড়ে তোলেন। চারদিকে ছি ছি পড়ে যায়। স্তাবকরা সুলতানকে জানায়, নোংরা কেচ্ছা রাষ্ট্র হওয়ার পেছনে দরবেশ নিজামের হাত রয়েছে। রুষ্ট সুলতানের হুকুমে গিয়াসপুর দরগাহে সব রকম রসদ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। খাজা নিজামুদ্দিন বিচলিত না হয়ে এক টুকরো কাগজে ‘আল্লাহ’ লিখে তা দরগাহের প্রবেশ তোরণে সাঁটিয়ে দিলেন। ভক্তদের আগমন অনেক বেড়ে গেল। তাঁরা সঙ্গে করে নিয়ে আসে নানারকম খাদ্যসামগ্রী। সুলতান বুঝলেন, তিনি বিরাট বোকামি করে ফেলেছেন।
এদিকে সুলতান কুতুবউদ্দিন মুবারক শাহর নতুন বিপদ। তাঁর মূত্রনালি সংকুচিত হয়ে পড়ায় প্রস্রাব হয় না। চিকিৎসকরা অনেক চেষ্টায়ও তাঁকে সুস্থ করতে পারছিলেন না। সুলতানের মা ছুটে গেলেন গিয়াসপুর দরগাহে। মিনতি জানালেন, ‘বাবা, ছেলেটারে মাফ করে দিন।’ খাজা বলেন, ‘আগে তাঁকে সিংহাসন ছাড়তে হবে। তারপর পেসাবের ব্যবস্থা।’ ছেলের পেসাব করা একটি গামলা মাথায় করে প্রাসাদ থেকে গিয়াসপুর পর্যন্ত নগ্ন পায়ে হেঁটে আসেন সুলতানের মা। হাতে ছিল মজবুত কাগজে লেখা দলিল। তাতে লেখা ‘আমি সব ক্ষমতা নিজাম দরবেশের হাতে অর্পণ করলাম।’ দলিলটা পড়ে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে পেসাবভরা গামলায় ফেলে দিলেন খাজা নিজামুদ্দিন। বললেন, ‘দুনিয়াবি রাজত্বকে আমরা দরবেশরা এভাবে গুরুত্ব দিই।’
৪. সুস্থ হওয়ার পর ফের গোয়ার্তুমিতে মেতে উঠলেন কুতুবউদ্দিন মুবারক শাহ। তিনি হুকুম দিলেন, তাঁর জন্য আল্লার দরবারে মোনাজাত করতে হবে সব মুসলমানকে- খাজাকেও কুউওয়াতুল মসজিদে জড়ো হতে হবে। সুলতানি ফরমান উপেক্ষা করে খাজা নিজামুদ্দিন একটি ফারসি কবিতা আওড়ান-‘ওরে ও শিয়াল, তুই তোর সীমানাতেই থাক/ কেন সিংহের সঙ্গে গোল বাধিয়ে/ ত্বরন্বিত করছিস নিজের সর্বনাশ।’
সেদিনই ১৩২০ সালের বিকালে কুতুবউদ্দিনকে হত্যা করেন তাঁর প্রেমিক খসরু খান। এরপর ‘নাসিরউদ্দিন মোহাম্মদ’ নামধারণ করে সিংহাসনে বসে পড়েন। নতুন সুলতানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন সেনাপতি গিয়াস উদ্দিন তুগলক। নাসিরউদ্দিনের দেহ টুকরো টুকরো করে নগরীর এখানে ওখানে ছুড়ে ফেলা হয়েছিল। গিয়াসউদ্দিন তুগলক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে অভ্যস্ত। তিনি সোনালি রঙের ইট দিয়ে নতুন এক শহর বানিয়ে নাম দিলেন ‘তুগলকাবাদ’। হুকুম দিলেন সব নাগরিক ওই শহরের বাসিন্দা হবে। খাজা নিজামুদ্দিন বলেন, ‘ওখানে কিসের শহর! ওটা তো ডাকাতদের আস্তানা হবে।’ কথাটা সুলতানের কানে পৌঁছানো হলে রুষ্ট গিয়াসউদ্দিন ঘোষণা করেন, ‘নিজাম দরবেশের আস্তানা গুঁড়িয়ে দেব।’
দিল্লির কোতোয়াল ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি ছিলেন খাজার মুরিদ। বললেন, সুলতান বিদ্রোহ দমন করতে বাংলায় গেছেন। ফিরে এসেই দরগাহে হামলা করবেন। স্মিত হেসে খাজা বলেন, দিল্লি দূর অস্ত। বাংলা থেকে ফিরে রাজধানীতে প্রবেশ করছিলেন সুলতান। কোতোয়াল আবার হুঁশিয়ারি দেন-‘বাবা! সুলতান তো এসে পড়ছেন।’ খাজা বলেন, ‘দিল্লি হনুজ দূর অস্ত।’ দিল্লি এখনো বেশ দূরে। বিজয়ী সুলতানকে হাতি ঘোড়া সৈন্যসামন্ত সমেত সংবর্ধিত করতে অনেক তোরণ খাড়া করা হয়েছিল। দিল্লির শহরতলিতে ১৩২৫ সালে একটি হাতির ধাক্কা লেগে তোরণ ধসে পড়লে তাতে প্রাণ যায় গিয়াসউদ্দিন তুগলকের। তাঁর সাধের শহর তুগলকাবাদ কালক্রম রূপ নেয় বন্য পশু আর ডাকাতদের আবাসস্থলে।
লেখক : সাংবাদিক