দেখতে দেখতে পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মহাপ্রয়াণের ছয় বছর হয়ে গেল। বর্তমান প্রজন্মের অনেকের কাছেই হয়তো এই রাষ্ট্রনায়কের অনন্য অবদানের অনেক কিছুই অজানা। আজকের আধুনিক বাংলাদেশের গোড়াপত্তন হয়েছিল এরশাদের ৯ বছরের শাসনামলে। ওই সময়টায় তিনি দেশজুড়ে ছড়িয়ে দেন উন্নয়নের ছোঁয়া, ঢাকাকে পরিণত করেন মেগাশহরে। তাঁর শাসনকালে প্রেসিডেন্ট এরশাদ বিশেষ গুরুত্ব দেন ৬৮ হাজার গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রা পাল্টে দিতে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার মাত্র সাত বছরের মাথায় এরশাদ যখন ক্ষমতায় আসেন, তখন খোদ ঢাকা শহরের অবস্থা অনেকটাই যে কোনো অনুন্নত মফস্বল শহরের মতো। যোগাযোগব্যবস্থার এক করুণ দশা। ঢাকা শহর থেকে লাগোয়া কেরানীগঞ্জ যেতেও বুড়িগঙ্গা নদী পার হতে হতো নৌকায়। উত্তরবঙ্গের সঙ্গে ঢাকা শহরের যোগাযোগব্যবস্থাও ছিল বেশ কষ্টকর। যানবাহনকে নদী পার হতো ফেরিতে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা যাত্রীদের অপেক্ষা করতে হতো চরম দুর্ভোগ সহ্য করে। একইভাবে ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রাম কিংবা ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ গোটা পূর্বাঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থাও ছিল অসম্ভব অনগ্রসর। ফেরি ছাড়া নদী পার হওয়ার আর কোনো পথ ছিল না। মোদ্দাকথায় বাংলাদেশটাই যেন ছিল এক অনগ্রসর ‘পল্লী’। এসব বাস্তবতার মাঝেই বাংলাদেশকে নিয়ে দূরদর্শী এক স্বপ্ন দেখেন পল্লীবন্ধু এরশাদ।
রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে এরশাদ দিয়েছেন উন্নয়ন সমৃদ্ধি। গড়েছেন স্বনির্ভরতার সোপান, সৃষ্টি করেছেন অর্থনৈতিক মুক্তির পথ। এখানে তার উদাহরণ উল্লেখ প্রয়োজন। কারণ এরশাদ আমলের স্বর্ণোজ্জ্ব¡ল অধ্যায়ের কথা সাধারণ মানুষের মুখে মুখে এখনো উচ্চারিত হয়। এযাবৎকালের সব সরকারের তুলনায় শ্রেষ্ঠত্বের পেন্ডুলাম এরশাদের জাতীয় পার্টির দিকে। তারপর রাজনীতিবিদ হিসেবে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ হলেন সেই নেতা-যিনি হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি, সংঘাত-সন্ত্রাসের রাজনীতির বিপরীতে শান্তি, সমৃদ্ধি, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সভ্যতা, ভদ্রতা, মনুষ্যত্ব, মানবিকতা বিকাশের রাজনীতি প্রচলনের চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। এরশাদ শুধু এ দেশের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসেই নয়, তিনি অমরত্ব লাভ করেছেন তার কর্মে, কৃতিত্বে, ন্যায়নীতি ও আদর্শে। এ দেশে যত দিন উপজেলাব্যবস্থা থাকবে তত দিন এরশাদের নাম উচ্চারিত হবে প্রতিটি মানুষের মুখে মুখে। তিনি ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করেছেন। শুক্রবারকে তিনি সাপ্তাহিক ছুটির দিন ঘোষণা করেছেন। অসংখ্য মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ করে ইসলামের সেবা করেছেন। অন্যান্য ধর্মের জন্য ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করে দিয়েছেন। জন্মাষ্টমীর দিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করেছেন। তাঁর শাসনামলে কোনো বৈষম্য ছিল না। পল্লীবন্ধু এরশাদ ছিলেন উন্নয়ন-সমৃদ্ধির বরপুত্র। কে মুছে দিতে পারবে তাঁর এই অমর কীর্তি! তিনি যমুনা সেতু, বুড়িগঙ্গা, মেঘনা, কামারখালী সেতুসহ ৫০৮টি ছোটবড় সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ করেছেন। ১০ হাজার মাইল পাকা রাস্তা নির্মাণ করে দেশের যোগাযোগব্যবস্থায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দিয়েছেন। দেশের রাজধানীসহ সব জেলা শহরের সড়কে তিনি সোডিয়াম বাতির ব্যবস্থা করেছেন। পল্লীবন্ধু এরশাদের ঔষধনীতি ও ভূমি সংস্কারনীতি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে এবং দেশ ও জাতি উপকৃত হয়েছে। সর্বোপরি প্রশাসনিক সংস্কারের মাধ্যমে উপজেলাব্যবস্থা প্রবর্তন করে মানুষের দোরগোড়ায় বিচারব্যবস্থা পৌঁছে দিয়েছেন এবং অনুন্নত গ্রামবাংলাকে উন্নয়নের আওতায় নিয়ে এসেছেন। তিনি মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধে সৈন্য পাঠিয়ে শান্তিমিশনে বাংলাদেশের সৈন্য প্রেরণের পথ উন্মুক্ত করেছেন। বাংলাদেশে এমন কোনো সেক্টর নেই যেখানে পল্লীবন্ধু এরশাদের উন্নয়ন-সমৃদ্ধির ছোঁয়া লাগেনি। ‘৬৮ হাজার গ্রাম বাঁচলেই বাংলাদেশ বাঁচবে’-এই কালজয়ী স্লোগান নিয়েই হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয়েছিল। ক্ষমতা গ্রহণ করে ১৮ দফা কর্মসূচি নিয়ে এক নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নই শুধু নয়, তা বাস্তবায়নের জন্য তিনি অবিশ্রাম কাজ করেছেন। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পার্টি গঠনের পর থেকে জাতীয় পার্টির ঘোষিত লক্ষ্যের প্রতি অবিচল থেকে জাতিকে একটি সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন। আমরা উত্তরসূরি হিসেবে তাঁর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে যেতে অঙ্গীকারবদ্ধ।
১৪ জুলাই, ২০১৯ সাল। এই দিনেই দেশের এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, রাষ্ট্রনায়ক, উন্নয়ন-সমৃদ্ধি ও সংস্কারের বরপুত্র পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ইন্তেকাল করেন। তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন প্রিয় রংপুরে তাঁর আপন নিবাস ‘পল্লী নিবাসের’ ছায়া সুশীতল লিচুবাগানের মাটির ঘরে। কিন্তু বাংলাদেশজুড়ে রয়ে গেছে তার সুনিপুণ উন্নয়ন-সমৃদ্ধির হাতের ছোঁয়া। আধুনিক বাংলাদেশ গঠনের প্রাণপুরুষ আজ আর আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু প্রতিনিয়ত তিনি বেঁচে আছেন এ দেশের কোটি মানুষের চিন্তা, চেতনা ও প্রেরণায়। চিরকাল তিনি মানুষের হৃদয়ে কনক প্রদীপ হয়ে জ্বলবেন।
লেখক : রাজনৈতিকব্যক্তিত্ব