আল্লাহর ইবাদত করার জন্য মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এ ইবাদত করার জন্য যেসব গুণ প্রয়োজন তার একটি আখলাকে হাসানা। ইসলামের দেয়াল দাঁড়িয়ে আছে আখলাকে হাসানার সুন্দর কর্মকাণ্ডের ওপর। মহান আল্লাহর ঘোষণা, ‘আপনি অবশ্যই মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত হে নবী! সুমহান চারিত্রিক গুণাবলি আপনার মধ্যে বিদ্যমান, যা হেদায়েতের জন্য অতি প্রয়োজন।’ এ প্রসঙ্গে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘ইমানদার লোকদের মধ্যে ইমান ও বিশ্বাসের দিক থেকে ওই ব্যক্তিই পূর্ণতাপ্রাপ্ত, যে তাদের মধ্যে নৈতিক চরিত্রের দিক থেকে উত্তম।’ অন্য এক বর্ণনায় তিনি বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন মুমিনদের দাঁড়িপাল্লায় নৈতিক চরিত্র অপেক্ষা অধিক ভারী জিনিস অন্য কিছুই হবে না।’ আরেক বর্ণনায় বলা হয়েছে, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘উত্তম নৈতিকতার পরিপূর্ণ বিকাশের জন্যই আমার আগমন।’
মানবকুলের জন্য ইসলাম একটি সামগ্রিক জীবনবিধান। এ জীবনবিধান বিশেষ সময়ের নয়, বরং সর্বকালের জন্য। আখলাকে হাসানা বা সচ্চরিত্র মনুষ্য জীবনের বড় সম্পদ। ইসলামে সচ্চরিত্রকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে; যা ছাড়া ইসলামি জীবনবিধান কল্পনাও করা যায় না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যে নিজেকে শুদ্ধ করে, সে-ই সফলকাম হয় এবং যে নিজেকে কলুষিত করে সে ব্যর্থ মনোরথ হয়।’ সুরা আশ শামস, আয়াত ৯-১০। ইসলাম হলো মানবতার জন্য বিশ্বজনীন এক ধর্ম। এ ধর্ম মানুষকে সর্বদা সুন্দর চরিত্র গঠনের শিক্ষা দেয়। বিশ্বাসীদের আমলসমূহের ভিতর এটা সর্বোত্তম। প্রকৃতপক্ষে একে দীনদারি, পরহেজগারি ও আবেদদের অধ্যবসায়ের ফল বলা হয়। যারা নিজেদের চরিত্রকে সুন্দর ও ঠিক রাখে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী তাদের মর্যাদা ও সম্মান দুনিয়া ও আখিরাতে সমুন্নত থাকবে।
মুসলমানদের যেসব ইসলামি চরিত্র অবলম্বনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তার একটি হলো আমানতসমূহ তার অধিকারীদের কাছে আদায় করে দেওয়া। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লøাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন আমানতসমূহ তার হকদারদের কাছে আদায় করে দিতে।’ সুরা আন নিসা, আয়াত ৫৮।
রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা সততা অবলম্বন করো, কেননা সত্যবাদিতা পুণ্যের পথ দেখায় আর পুণ্য জান্নাতের পথ দেখায়, একজন লোক যদি সর্বদা সত্য বলতে থাকে এবং সত্যের প্রতি অনুরাগী হয়, ফলে আল্লাহর কাছে সে সত্যবাদী হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়ে যায়।’ মুসলিম।
রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সম্প্রদায়ের কাছে আল আমিন উপাধি লাভ করেছিলেন, তারা তাঁর কাছে তাদের সম্পদ আমানত রাখত। তিনি ও তাঁর অনুসারীদের মুশরিকরা কঠোরভাবে নির্যাতন শুরু করার পর যখন আল্লাহ তাঁকে মক্কা থেকে মদিনা হিজরত করার অনুমতি দিলেন তিনি আমানতের মালামালসমূহ তাঁর অধিকারীদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা না করে হিজরত করেননি। অথচ যারা আমানত রেখেছিল তারা সবাই ছিল কাফির। ইসলাম তো আমানত তার অধিকারীদের কাছে ফিরিয়ে দিতে নির্দেশ দিয়েছে, যদিও তার অধিকারীরা অমুসলিম হয়।
আখলাকে হাসানা বা সচ্চরিত্রের ভিত্তি হলো ইমান আনয়নপূর্বক আল্লাহকে ভয় করা, মৃত্যু-পরবর্তী জীবনকে অধিক স্মরণ করা এবং সব সময় রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নতের ওপর চলা। সব সময় ভালো কাজে নিয়োজিত থাকা, মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকা, এমনকি মন্দ কাজের পথ খুলে যেতে পারে এমন কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখা। ইসলামের দৃষ্টিতে নৈতিকতার মূল চাবিকাঠি তাকওয়া বা পরহেজগারি, যা নৈতিকতার ভূষণ। এ প্রসঙ্গে আল কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘যদি তোমরা বড় বড় গুনাহ থেকে বিরত থাকো, তবে ছোট ছোট গুনাহগুলো আল্লাহ ক্ষমা করে দেবেন এবং তোমাদের সম্মানজনক স্থানে প্রবেশ করাবেন।’ নৈতিকতার উত্তম নিদর্শন সম্পর্কে বলতে গিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কোনো বান্দা মুত্তাকির মধ্যে ততক্ষণ পর্যন্ত গণ্য হতে পারবে না যতক্ষণ সে কোনো মন্দ কাজ করার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় সেসব জিনিসও পরিত্যাগ করবে, যাতে কোনো দোষ বা মন্দ নেই।’ তাই প্রত্যেক মানুষের উচিত নৈতিকতার চর্চা করা। মহান আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের একমাত্র পথ তাকওয়া বা আল্লাহভীতি। আর এ তাকওয়া অর্জনের পূর্বশর্ত হলো উত্তম চরিত্রের অধিকারী হওয়া। আমদের একটু গভীরভাবে চিন্তা করা উচিত, এ দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী। কিছুদিন বসবাস করার পর এ দুনিয়ার মায়া ছেড়ে আমাদের চলে যেতে হবে। একমাত্র ‘আখলাকে হাসানা’ বা উত্তম চরিত্র ছাড়া আর কিছুই আমাদের সঙ্গী হবে না।
লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক