কৃষিপণ্য বিপণনে সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব অপরিসীম।
কৃষিপণ্য ব্যবসায় প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে সাপ্লাই চেইনের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার বিকল্প নেই। সাপ্লাই চেইনের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বলতে বোঝায়- পণ্য বা সেবা উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তা বা গ্রাহকের হাতে পৌঁছানো পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়ায় সম্ভাব্য সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা, তাদের প্রভাব কমানো এবং বিকল্প পরিকল্পনা তৈরি করা। এর লক্ষ্য হলো কৃষিপণ্য ব্যবসার ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করা ও অপচয় কমানো। সঠিক সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থাপনা উৎপাদন, পরিবহন, গুদামজাতকরণ ও বিতরণ খরচ কমায়। কাঁচামাল থেকে শুরু করে ক্রেতার হাতে পণ্য পৌঁছানো পর্যন্ত অপ্রয়োজনীয় ধাপ কমে যায়। খরচ কমলে কৃষক বা উদ্যোক্তা প্রতিযোগিতামূলক দামে পণ্য দিতে পারে এবং মুনাফা বাড়াতে পারে। সাপ্লাই চেইন সুসংগঠিত হলে পণ্য নির্ধারিত সময়ে সরবরাহ করা সম্ভব হয়। গ্রাহকের চাহিদা দ্রুত পূরণ হলে ব্র্যান্ডের প্রতি আস্থা ও পুনরায় ক্রয়ের সম্ভাবনা বাড়ে। মানসম্মত উপকরণ সঠিক সময়ে সংগ্রহ ও সঠিকভাবে ব্যবহার করলে পণ্যের গুণগত মান নিশ্চিত হয়। মান বজায় থাকলে বাজারে ব্র্যান্ড ভ্যালু বাড়ে। চাহিদা হঠাৎ বেড়ে গেলে বা কমে গেলে দ্রুত সরবরাহ সমন্বয় করা সম্ভব হয়। কৃষিপণ্যের মৌসুমি ব্যবসার ক্ষেত্রে এটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। যেসব উদ্যোক্তা সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থাপনায় দক্ষ, তারা দ্রুত, সাশ্রয়ী ও মানসম্মত পণ্য সরবরাহ করতে পারে। এতে তারা বাজারে প্রতিযোগীদের তুলনায় এগিয়ে থাকে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কাঁচামালের ঘাটতি বা পরিবহন সমস্যা- এসবের প্রভাব কমাতে বিকল্প উৎস ও পরিকল্পনা তৈরি করা গেলে কৃষি ব্যবসা ভালো টেকসই হয়। বৈশ্বিক মানের সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থাপনা সঠিক থাকলে উদ্যোক্তা সহজে রপ্তানি বাজারে প্রবেশ করতে পারে। সময়মতো ডেলিভারি ও মান বজায় রাখা আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের আস্থা অর্জন সহজ হয়।
উদ্যোক্তাদের জন্য সরবরাহ চেইনে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এটি দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করা গেলে ব্যবসার খরচ ও ক্ষতি কমানো যায়, সময় বাঁচে, ব্যবসার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা সহজ হয়, গ্রাহকের আস্থা বৃদ্ধি পায়। কৃষিপণ্য বিপণন ঝুঁকির ধরনের মধ্যে রয়েছে- উৎপাদন ও সরবরাহের ঝুঁকি। উপকরণ সময়মতো না পাওয়া, উৎপাদন হঠাৎ কমে যাওয়া, যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়া ও দক্ষ শ্রমিকের ঘাটতি, যানজট, দুর্ঘটনা বা পরিবহন ধর্মঘট, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ইত্যাদি।
এসব ঝুঁকি মোকাবিলা করার জন্য দরকার পণ্য বিপণনে বা সরবরাহে দক্ষতা অর্জন, মানসিকভাবে শক্ত থাকা এবং শক্তিশালী মার্কেট নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা। তার জন্য বেশ কিছু কৌশল অবলম্বন করা জরুরি। যেমন ঝুঁকি শনাক্তকরণ ও মূল্যায়ন; পণ্য সরবরাহের প্রতিটি ধাপে সম্ভাব্য ঝুঁকি তালিকাভুক্ত করা; ঝুঁকির প্রভাব ও সম্ভাবনা মূল্যায়ন করা; বিকল্প সরবরাহ উৎস রাখা যেমন একাধিক সরবরাহকারীর সঙ্গে চুক্তি করা, মজুত ব্যবস্থাপনা উন্নত করা; চাহিদা অনুযায়ী স্টক সমন্বয় রাখা ইত্যাদি। এ ছাড়াও প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ঝুঁকি মোকাবিলা করা যায় যেমন রিয়েল-টাইম ট্র্যাকিং সিস্টেম জানা ও ব্যবহার করা; ডাটা অ্যানালিটিক্সের মাধ্যমে পণ্যের চাহিদা পূর্বাভাস জেনে নেওয়া; গুণগত সমস্যা বোঝা; দুর্যোগের সময় বিকল্প পরিবহন রুট ব্যবহার করা। ঝুঁকি মোকাবিলায় বিমা কভারেজ একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল; যার মাধ্যমে পরিবহন, গুদাম ও পণ্য বিমা করা যেতে পারে।
বিপণন ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কেবল শুধু পণ্য বা সেবা উৎপাদন ও সরবরাহের কৌশল নয়, এটি ব্যবসার সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। কৃষিপণ্য উৎপাদনে এক বা দুই প্রজাতির ফসলের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে বহুমুখী ফসল উৎপাদন করা; রোগবালাই সহনশীল জাত ব্যবহার করা, সেচ ও আবহাওয়াভিত্তিক পূর্বাভাস ব্যবস্থা রাখা; মাঠপর্যায়ে ছোট গুদাম ও কোল্ড স্টোরেজ স্থাপন করা; সঠিক সময়ে ফসল সংগ্রহ করা যাতে পচন বা অপচয় রোধ করা যায়; ভালো রাস্তা তৈরি, উন্নত প্যাকেজিং এবং তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত পরিবহনের ব্যবস্থা করা; চুক্তিভিত্তিক বিপণনে যাওয়া (কৃষক ও ব্যবসায়ীর মধ্যে পূর্ব চুক্তি থাকলে দাম ওঠানামার ঝুঁকি কমে); বাজার তথ্যপ্রবাহ ঠিক রাখা, মোবাইল অ্যাপ আপডেট রাখা, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম বা কমিউনিটি রেডিওর মাধ্যমে বাজার মূল্য ও চাহিদা জানার ব্যবস্থা করা; সরকার কর্তৃক মূল্য সহায়তা বা ফসল ক্রয় নীতি চালু রাখা; ফসল, পশু ও মাছের জন্য কৃষি বিমা চালু ও সহজলভ্য করা; দুর্যোগ প্রস্তুতি গ্রহণে কৃষক ও সরবরাহকারীকে ঝুঁকি মোকাবিলা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে।
লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ