আমার একজন ভক্ত পাঠক মোহাম্মদ মাহতাব উদ্দিনকে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়েছিলাম। আজ পরিচয় করাব আরেকজন ভক্ত পাঠককে। তার নাম মীজান মোহাম্মদ, বাড়ি ঝিনাইদহে। গত বৃহস্পতিবার তিনি আমাকে দুই পৃষ্ঠার একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। আমার লেখা নিয়ে অনেক কথা লিখেছেন। লেখা সম্পর্কে কী বলেছেন তা উল্লেখ করলাম না। কারণ মুরুব্বিরা বলতেন, নিজের ঢোল নিজে পেটাতে নেই। অবশ্য এখন মুরুব্বিদের সেই পরামর্শ আর কাজ করে না। এখন নিজের ঢোল নিজেই পিটিয়ে, ফাটিয়ে, প্রয়োজনে রাস্তায় ফেলে রাখতে হবে, যেন অন্যরা দেখে। আমি অবশ্য সব সময় মুরুব্বিদের কথা মেনেই চলি। মীজান মোহাম্মদ অত্যন্ত রাজনীতিসচেতন মানুষ। তিনি শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমানের রাজনীতির সফলতা-ব্যর্থতার কথা বলেছেন। তারেক রহমানের সম্ভাবনার কথা বলেছেন। নির্বাচন নিয়ে কথা বলেছেন। তার বক্তব্য হলো, দুই দিন আগে বা পরে হোক, নির্বাচন হবেই। নির্বাচন হতেই হবে। নির্বাচন নিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের মাথাব্যথা নেই। সাধারণ মানুষের ভাবনা হলো, নির্বাচন হলে দেশ পরিচালনার ভার আমরা কাদের হাতে তুলে দেব? বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সফল নেতা, সফল রাষ্ট্রনায়ক হবেন, নাকি ব্যর্থ তিতুমীর, টিপু সুলতান, সিরাজউদ্দৌলা হবেন? আমি নিশ্চিত যে, একজন পাঠকের তীক্ষè রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র করে আজকের লেখায় বিএনপির হাইব্রিড, সুযোগসন্ধানী কিছু নেতা আমার ওপর মহাক্ষিপ্ত হবেন। কারণ শুনেছি তারা নাকি এখন পকেটে ব্লাড টেস্ট করার যন্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরা করেন। কে বিএনপি, কে বিএনপি নয় তা নাকি ওই যন্ত্রে ধরা পড়ে। সেজন্যই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে অনুরোধ জানাচ্ছি, দয়া করে মনে কিছু করবেন না। একজন মীজান মোহাম্মদের ভালোবাসা অনুধাবন করুন। দলের এবং দেশের উপকার হবে।
মীজান মোহাম্মদ তার রাজনৈতিক বিশ্লেষণে লিখেছেন, দল তৈরি করলেই ঝুড়িঝুড়ি ভোট পাওয়া যায় না। সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো ক্ষমতা থাকতে হয়। এ ক্ষেত্রে শেখ মুজিবুর রহমানের কথাটি আলাদা বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। কারণ তখন সবার চাওয়া ছিল দেশের স্বাধীনতা। সবার লক্ষ্য ছিল দেশটা স্বাধীন করতে হবে। এজন্য কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে, কারও ইমোশন কাজে লাগাতে হবে-এসব কিছু করার প্রয়োজন হয়নি শেখ মুজিবের। সবার চাওয়া পূরণ করার জন্য তিনি এগিয়ে গেছেন এবং সফল হয়েছেন। স্বাধীনতাযুদ্ধের ডাক দেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন এবং সে সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন।
বিএনপির জন্ম ও জিয়াউর রহমানের রাজনীতি পর্যালোচনা করে তিনি লিখেছেন, বিএনপির জন্ম স্বাধীনতার কিছু সময় পরে। সে সময় আরও কিছু রাজনৈতিক দলের জন্ম হয়েছিল। ঝুড়িঝুড়ি ভোট পেয়েছিল একমাত্র বিএনপিই। এ দলের মতো নতুন সৃষ্ট কোনো রাজনৈতিক দল এত ভোট পায়নি। ভোটযুদ্ধে এত বড় বিজয় আর কোনো নতুন দল অর্জন করতে পারেনি। তিনি মনে করেন, ওই সময় নির্যাতিত, বিপদগ্রস্ত, অভাবী মানুষের পাশে বন্ধুর মতো দাঁড়িয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। সাধারণ মানুষের হাতে হাত রেখে নিজের হাতে কোদাল নিয়ে মাটি কেটেছিলেন। সে সময় জিয়াউর রহমানের সেই আচরণ ও নেতৃত্ব দেশবাসী গ্রহণ করেছিল। সে কারণে দেশের মানুষের অন্তরে আজও বেঁচে আছেন প্রেসিডেন্ট জিয়া।
জুলাই বিপ্লবের মূল্যায়ন করে মীজান মোহাম্মদ কিছু বাস্তব সত্য তুলে ধরেছেন। সেই সঙ্গে কিছু প্রশ্নও রেখেছেন। তিনি মনে করেন, সব আচরণ সব সময় মূল্য পায় না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি, চাহিদা ভিন্ন হয়। সময়ের প্রয়োজনে জুলাই বিপ্লব হয়েছে। গণ অভ্যুত্থানের পর বিপ্লবীরা নতুন দল গঠন করেছেন। বিপ্লবীরা যদি সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ইতোমধ্যে পূরণ করতে পারতেন, দেশবাসী কী চায় বুঝতে পারতেন তাহলে তারাও হয়তো আগামী নির্বাচনে ঝুড়িঝুড়ি ভোট পেতেন। কিন্তু বিপ্লবীরা তা বুঝতে পারছেন না। তাদের বিপ্লব ধীরে ধীরে থেমে যাচ্ছে। বিপ্লবীরা শক্তিশালী পাহাড় গুঁড়িয়ে দিলেন, উত্তাল সাগর সাঁতরিয়ে তীরে উঠলেন কিন্তু চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজদের ভয় দেখাতে পারলেন না। তিনি মনে করেন, দেশবাসী এখন চাঁদাবাজ-সন্ত্রাস-দুর্নীতিমুক্ত একটি সমাজ দেখতে চায়। দেশবাসীর এর চেয়ে বেশি চাওয়া আপাতত নেই। দেশের মানুষ নিরাপত্তা ও শান্তি চায়।
আগামী নির্বাচন ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্পর্কেও মীজান মোহাম্মদের অনেক উচ্চাশা এবং শঙ্কা দুটোই আছে। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘বর্তমানে যে পরিবেশ বিরাজ করছে, তাতে সময়মতো নির্বাচন হলে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব তারেক রহমানের কাঁধেই পড়বে। তিনি ব্যর্থ হবেন, নাকি সফল সেটা আগামী দিনগুলোই বলে দেবে। সত্যিকারের উন্নতমানের একজন নেতা হবেন, এটাই দেশবাসীর কামনা। শ্রেষ্ঠ মানুষ আর সফল মানুষ এক নয়। অনেক ব্যর্থ মানুষও শ্রেষ্ঠ হয়েছেন। তিতুমীর, টিপু সুলতান, নবাব সিরাজউদ্দৌলা সফল হননি। কিন্তু আজও তারা আমাদের কাছে শ্রেষ্ঠ মানুষ। সফলতা পরিবেশ-পরিস্থিতির ব্যাপার। মন থাকলেও সবকিছু অনুকূলে না থাকলে তার ফল ঘরে তোলা যায় না। দুখীর সাথি হয়ে দুঃখ সহ্য করা যায়, কিন্তু বদের বদ আচরণ রাজার হালে থেকেও মেনে নেওয়া যায় না। এ মুহূর্তে তাঁর (তারেক রহমান) যেটা নিয়ে অস্থির হওয়া দরকার, সেটা হলো দলের শৃঙ্খলা। প্রতিদিন দুর্নাম ছড়াচ্ছে, যেটা দলের জন্য মোটেই শুভ নয়।’
মীজান মোহাম্মদ রাজনীতি ও সমাজসচেতন জাতীয়তাবাদী চিন্তার একজন মানুষ। তার দুই পৃষ্ঠার চিঠি পড়ে আমার তা-ই মনে হয়েছে। চিঠির বিভিন্ন অংশ উদ্ধৃত করে যে বিষয়গুলো এ লেখায় উল্লেখ করা হলো, সবই তার নিজস্ব চিন্তা। তবে বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে প্রতিটি দেশপ্রেমিক মানুষের চিন্তার সঙ্গে তার চিন্তা মিলে যাবে। ব্যক্তিগতভাবে আমিও তার সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে একমত। আমজনতা বা সাধারণ মানুষকে আমরা সাধারণ ভাবি। কিন্তু তারা কেউই সাধারণ নন। সবাই অসাধারণ। গ্রামের চায়ের দোকান বা রাস্তার পাশে হকারের দোকানে আড্ডায় এমন সব তাত্ত্বিক তথ্য পাওয়া যায়, যা শহুরে সুশীলরাও ভাবতে পারেন না। আমাদের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাই একেকজন রাষ্ট্রনায়ক বা সরকারপ্রধান একেক সময়ের প্রয়োজনে আবির্ভূত হয়েছেন। তারা কেউ কেউ সময়ের অনুভূতি ধারণ করতে পেরেছেন। কেউ কেউ পারেননি। জনগণকে যারা বুঝতে পারেননি, তাদেরই নির্মম পতন হয়েছে। টানা প্রায় ১৬ বছর ক্ষমতার চেয়ারে বসেও জনগণকে বুঝতে পারেননি শেখ হাসিনা। এর পরিণতি যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। ১৯৭৫ সালে তার পিতা শেখ মুজিবুর রহমান যখন নিহত হন, তখন তিনি জীবন দিয়েছেন, কিন্তু তার দল আওয়ামী লীগ ছিল। ৩২ নম্বরের বাড়িটি ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের ওপর পিতা-মাতা ও স্বজন হত্যার প্রতিশোধ নিতে গিয়ে শেখ হাসিনাকে পালাতে হয়েছে। তিনি তার কৃতকর্মের কারণে পিতাকে দ্বিতীয়বার হত্যা করলেন এবং সেই সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকেও গলা টিপে হত্যা করে নিজের জীবন নিয়ে দেশ থেকে পালিয়েছেন।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, দেশ নির্বাচন আয়োজনে প্রস্তুত। ফেব্রুয়ারিতেই ক্ষমতা হস্তান্তর। নানান সন্দেহ-সংশয় থাকলেও এ নোবেল লরিয়েটের প্রতি দেশবাসীর এখনো আস্থা আছে। তিনি আরও বলেছেন, এবার নির্বাচন হবে ঐতিহাসিক ও স্মরণীয়। বাংলাদেশের মানুষ এমন একটি নির্বাচনেরই অপেক্ষায় আছে। ঐতিহাসিকভাবে আমাদের দেশের মূল সমস্যাই হলো নির্বাচন। নির্বাচন কেন্দ্র করেই দেশটা স্বাধীন হলো। স্বাধীনতার ৫৪ বছরে দেশে যত সমস্যা তৈরি হয়েছে, সবই নির্বাচন কেন্দ্র করে। সেই কাক্সিক্ষত নির্বাচন ঐতিহাসিক ও স্মরণীয় হবে। এ খবর শুনেই দেশবাসী আনন্দিত। কিন্তু বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তার দলীয় নেতা-কর্মীদের বারবারই বলেছেন যে আগামী নির্বাচন হবে একটি কঠিন নির্বাচন। আগামী নির্বাচন এত সহজ হবে না বলে তিনি বারবার নেতা-কর্মীদের সতর্ক করছেন। কেন কঠিন হবে, কেন সহজ হবে না তা নিশ্চয় তিনি অনুধাবন করতে পারছেন। অনেক নেতা-কর্মী অনুধাবন করতে পারছেন বলে মনে হচ্ছে না।
দেশে এখন তিন শ্রেণির বিএনপি আছে-ত্যাগী বা পোড়-খাওয়া, হাইব্রিড এবং সুযোগসন্ধানী। ত্যাগী ও পোড়-খাওয়া বিএনপি তারা, যারা চিন্তা-চেতনায় শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নীতি-আদর্শ মনেপ্রাণে ধারণ করেন। বেগম খালেদা জিয়াকে জাতীয়তাবাদী শক্তির একমাত্র ঠিকানা মনে করেন। শহীদ জিয়া, বেগম খালেদা জিয়ার উত্তরসূরি তারেক রহমানের আদেশ-অনুরোধ পালনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। জুলাই বিপ্লবের পর হঠাৎ করেই একশ্রেণির মানুষের বিএনপিতে আগমন ঘটেছে, তারা পোড়-খাওয়া, নীরবে নিভৃতে থাকা নেতা-কর্মীদের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছেন। লন্ডনের নাম ভাঙিয়ে অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা-কর্মী-শুভাকাক্সক্ষীর সঙ্গে বেয়াদবি করে বেড়াচ্ছেন। তাদের সম্পর্কে দলের অনেকে রসিকতা করে বলেন, হাইব্রিডদের সঙ্গে ব্লাড টেস্ট করার যন্ত্র থাকে। ওই যন্ত্র দিয়ে ব্লাড টেস্ট করে তারা বলে দিতে পারেন কে বিএনপি, কে বিএনপি নয়। আরেক দল হলো সুযোগসন্ধানী। তারা বিএনপির নাম ভাঙিয়ে সারা দেশে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের নানান অপকর্মের কারণে ইমেজ সংকটে পড়ছে দল, বিব্রত হচ্ছেন দলের নেতা তারেক রহমান। এ সুযোগসন্ধানীরা দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে ছবি বা সেলফি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করে নিজেকে নেতা হিসেবে প্রকাশ করছেন এবং চাঁদাবাজির রেট বাড়িয়ে দিচ্ছেন।
প্রত্যেক পিতা-মাতারই প্রত্যাশা থাকে তার সন্তান যেন তাকে ছাড়িয়ে আরও বড় হয়। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার প্রত্যাশাও এমনই থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। তারেক রহমান বিগত ১৭ বছর সময়ের মূল্য দিয়ে নিজেকে গড়ে তুলেছেন। ১৭ বছর আগের তারেক রহমান আর আজকের তারেক রহমান এক নন। এর অন্যতম প্রমাণ হলো বিদেশে বসে পিতার সৃষ্ট, মায়ের শ্রমে বড় করা দলটি ধরে রেখেছেন। শত ষড়যন্ত্রের মধ্যেও দলটিকে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। নেতা হিসেবে নিজের যোগ্যতা ও দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছেন। পিতা ছিলেন দেশপ্রেমিক ও সৎ-মানুষ। মা হলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে ও ন্যায়নীতিতে আপসহীন। সে কারণে দেশবাসীর প্রত্যাশা হলো, তারেক রহমান এমন এক বিএনপির নেতৃত্ব নেবেন, যে বিএনপিতে কোনো হাইব্রিড জঞ্জাল থাকবে না। কোনো চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজ, সুযোগসন্ধানী থাকবে না। দেশবাসী এখন চাঁদাবাজ, সন্ত্রাস ও দুর্নীতিবাজমুক্ত রাজনৈতিক দল চায়। সেটা করার এখনই সময়। তা যদি তিনি করতে পারেন তাহলে পোড়-খাওয়া ত্যাগী নেতা-কর্মী এবং জাতীয়তাবাদী শক্তির লাখ লাখ সমর্থক শক্ত করে তারেক রহমানের হাত ধরবেন। জীবন দেবেন, তবু তারা নেতার হাত ছাড়বেন না। মনে রাখতে হবে, আগামী নির্বাচন হবে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে। হাইব্রিড জঞ্জাল, চাঁদাবাজ, দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী, সুযোগসন্ধানীরা যদি বিএনপির নাম ভাঙানোর সুযোগ পান, তাহলে সমাজে যারা ভালোমানুষ, যারা নীরবে বিএনপিকে সমর্থন করেন তারা মুখ ফিরিয়ে নেবেন।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন