বহুলপ্রত্যাশিত ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। রোডম্যাপে ভোট গ্রহণের তারিখ নেই। নেই তফসিল ঘোষণার তারিখও। তবে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় বা তৃতীয় সপ্তাহে তফসিল ঘোষণার আভাস রয়েছে। সরকার আগেই জানিয়েছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে। সে অনুযায়ী সাজানো হয়েছে পরিকল্পনা। রোডম্যাপে রয়েছে রাজনৈতিক দলসহ অংশীজনের সংলাপ, ভোটার তালিকা প্রণয়ন, নির্বাচনি আইনবিধি সংস্কার, দল নিবন্ধন, নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ, ভোট কেন্দ্র স্থাপন, পোস্টাল ভোটিং, পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধনসহ দুই ডজন কাজের সময়সূচি। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণসহ সবকিছুকেই চ্যালেঞ্জ মনে করছে নির্বাচন কমিশন। বুধবার এ পরিকল্পনা অনুমোদন করে ইসি। এরপর গতকাল দুপুরে নির্বাচন ভবনে সংবাদ সম্মেলন করে এ কর্মপরিকল্পনার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ।
তফসিল কবে এবং ভোট কবে হবে-এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ভোট গ্রহণের ৬০ দিন আগে তফসিল দেব। আমাদের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর বলেছে আগামী রমজানের আগে ভোট করার জন্য। আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে, তাহলে ১৭ বা ১৮ ফেব্রুয়ারি রমজান শুরু। আবার রমজান তো চাঁদ দেখার ওপর নির্ভরশীল। এভাবে আপনি নির্বাচনের তারিখ বের করতে পারেন।’
গণপরিষদ ও গণভোটের দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে সচিব বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনা জাতীয় নির্বাচনের জন্য, সংসদ নির্বাচনের বাইরে আমাদের অন্য কোনো কিছু ভাববার সুযোগ নেই।’
কর্মপরিকল্পনায় দুই ডজন বিষয় : অংশীজনের সংলাপ, ভোটার তালিকা প্রণয়ন, নির্বাচনি আইনবিধি সংস্কার, দল নিবন্ধন, নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ, ভোট কেন্দ্র স্থাপন, পোস্টাল ভোটিং, পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন, দেশিবিদেশি সাংবাদিক অনুমোদন, নির্বাচনের জন্য জনবল ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা, নির্বাচনি দ্রব্যাদি সংগ্রহ, আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক কার্যক্রম। অন্যান্য আইনবিধি সংস্কার ও একীভূতকরণ, ম্যানুয়াল, নির্দেশিকা, পোস্টার, পরিচয়পত্র মুদ্রণ, প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স উপযোগীকরণ, নির্বাচনি বাজেট বরাদ্দ, প্রচার ও উদ্বুদ্ধকরণ, টেলিযোগাযোগব্যবস্থা সুসংহতকরণ, ডিজিটাল মনিটর স্থাপন ও যন্ত্রপাতি সংযোজন, বেসরকারি প্রাথমিক ফলাফল প্রচার, ফলাফল প্রদর্শন, প্রকাশ ও প্রচার (বিভিন্ন মাধ্যমে), বিবিধ।
সংলাপ : দল ও অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপ সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে শুরু। শেষ হতে লাগবে দেড় মাস। এবারের সংলাপে আমন্ত্রণ পাবেন নিবন্ধিত দলের প্রতিনিধি, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম ব্যক্তি, নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও পর্যবেক্ষক এবং আহত জুলাই যোদ্ধারা।
ভোটার তালিকা হালনাগাদ : ইতোমধ্যে দ্বিতীয় ধাপের সম্পূরক খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে; যা চূড়ান্ত করা হবে ৩১ আগস্ট। আর ৩১ অক্টোবরের সম্পূরক তালিকা শেষে চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে ৩০ নভেম্বর।
নির্বাচনি আইনবিধি : গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও), অন্যান্য আইনবিধি ৩১ আগস্টের মধ্যে সংশোধনের প্রস্তাব ও প্রণয়ন। এ ছাড়া সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ আইন সংশোধন, ভোটার তালিকা আইন সংশোধন, সংসদ নির্বাচনের ভোটার কেন্দ্র নীতিমালা ও ব্যবস্থাপনা চূড়ান্ত, দেশিবিদেশি পর্যবেক্ষক ও সংবাদিক নীতিমালা চূড়ান্ত করা, নির্বাচন পরিচালনা (সংশোধন) আইন ২০২৫, নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন ১৯৯১, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন ২০০৯ সংশোধনের কাজ আইন মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন আছে, যা ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে শেষ করার আশা করছে ইসি।
রাজনৈতিক দল নিবন্ধন : মধ্য সেপ্টেম্বর নতুন দলের প্রাথমিক নিবন্ধন ও সেপ্টেম্বরের মধ্যে চূড়ান্ত প্রজ্ঞাপন দেবে ইসি।
সীমানা নির্ধারণ : সেপ্টেম্বরের শুরুতে সংসদীয় আসনের সীমানা চূড়ান্ত করে গেজেট প্রকাশ আর ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে জিআইএস ম্যাপ প্রস্তুত ও প্রকাশ করবে কমিশন।
পোস্টাল ভোটিং ও ব্যালট : প্রাবাসীদের ভোটদানের জন্য প্রকল্প অনুমোদন, সফটওয়্যার চূড়ান্ত, মোবাইল অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট, নিবন্ধন ও প্র্যাকটিসিং মডিউল, প্রচারের কাজ অক্টোবরের মধ্যে সম্পন্ন করবে ইসি। পোস্টার ব্যালট প্রবাসীদের কাছে প্রেরণ ও ভোটারদের কাছে পৌঁছানো হবে ৫ জানুয়ারির (২০২৬) মধ্যে।
আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক কার্যক্রম : সেপ্টেম্বরে ও তফসিল ঘোষণার ১৫ দিন আগে এবং তফসিল ঘোষণার পর বৈঠক করবে কমিশন। এ ছাড়া দেশি পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন করে চূড়ান্ত সার্টিফিকেট প্রদান ১৫ নভেম্বরের মধ্যে, নির্বাচনসংশ্লিষ্ট ম্যানুয়াল, নির্দেশিকা, পোস্টার, পরিচয়পত্র ইত্যাদি মুদ্রণ ১৫ নভেম্বরের মধ্যে, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স ও নির্বাচনি দ্রব্যাদি ব্যবহারোপযোগী করা ৩০ নভেম্বরের মধ্যে, নির্বাচন ভবনে বেসরকারি ফলাফল প্রদর্শনের জন্য ডিজিটাল মনিটর স্থাপন ও যন্ত্রপাতি সংযোজন ডিসেম্বরের মধ্যে।
প্রতিটি বিষয়ই চ্যালেঞ্জের, সংলাপে দলের সুপারিশ আমলে নেবে ইসি : সংসদ নির্বাচনের পথে ‘রোডম্যাপ’ ঘোষণার মধ্যে সবকিছু সময়ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা থাকলেও পরিস্থিতি বুঝে নতুন কিছুও যুক্ত হবে বলে জানান নির্বাচন কমিশন সচিব আখতার আহমেদ। ভোট সামনে রেখে প্রতিটি বিষয়ই ‘চ্যালেঞ্জের’ উল্লেখ করে তিনি জানান, পরিস্থিতি বুঝে তা সামাল দেওয়ার দৃঢ়তা রয়েছে বর্তমান ইসির। এখনকার আইনশৃঙ্খলার বিষয়টি সরকারের হলেও প্রয়োজনে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে সমন্বয় ও সহযোগিতা নেবে। সচিব জানান, সংস্কার বিষয়ে রাজনৈতিক দলের পরামর্শ থাকলেও প্রয়োজনে কর্মপরিকল্পনায় তা যুক্ত করা হবে।
কর্মপরিকল্পনার ভিতরে-বাইরে কোনো চ্যালেঞ্জ রয়েছে কি না-জানতে চাইলে সচিব বলেন, ‘প্রতিটি জিনিসই চ্যালেঞ্জের। প্রতিটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মানুষের প্রস্ততি থাকতে হবে, এটাই দৃঢ়তা। এটাই আমরা চাই।’
বিরাজমান পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু ভোটের পরিবেশ রয়েছে কি না-জানতে চাইলে আখতার আহমেদ বলেন, ‘কেন থাকবে না! এক্সিস্টিং ল অ্যান্ড অর্ডার সিচুয়েশনটা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিষয়। আমাদের বিষয়টা হচ্ছে নির্বাচনসংক্রান্ত কার্যক্রমের।’ ভোট কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা বা বডি ক্যাম ব্যবহারের বিষয়টিও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যাপার বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘আমরা চাইব শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠুভাবে ভোট গ্রহণ হোক। ভোটার স্বতঃস্ফূর্তভাবে, আনন্দমুখর পরিবেশে আসবে। তার জন্য অংশীজন হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যদি মনে করে এটা (কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা) করতে হবে, অবশ্যই করবে। আমরা সহযোগিতা করব।’
রোডম্যাপে রাজনৈতিক দল সন্তুষ্ট হবে কি না-জানতে চাইলে সচিব বলেন, ‘এটা আমাদের কর্মপরিকল্পনা। রাজনৈতিক দল ও অংশীজনের সঙ্গে যখন আলোচনা হবে তখন মতামত থাকলে আমাদের নিশ্চিত করবেন। এটার সঙ্গে সংযোজন হতে পারে।’
দলের সঙ্গে সংলাপ পরে করায় উল্টো (দলের মতামত উপেক্ষা) হচ্ছে কি না-জানতে চাইলে ইসি সচিব বলেন, ‘এ কথার সঙ্গে একমত নই। স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে সংলাপ-পরবর্তী কোথাও যদি সংশোধনের প্রয়োজন হয়, আমরা বলেছি কর্মপরিকল্পনায় সংযোজন হবে, সে ক্ষেত্রে আমরা সেভাবে অ্যাডজাস্ট করব।’ ইসি সচিব জানান, এআইয়ের অপব্যবহার, অপপ্রচার, মিসইনফরমেশন, ডিসইনফরমেশন রোধ একটা চ্যালেঞ্জ। ভোট দিতে কমিশনের সব উদ্যোগের পরও কোনোভাবেই যদি কেউ উৎসাহিত না হন, সেটাই বড় চ্যালেঞ্জ।
পার্বত্য এলাকায় হেলিকপ্টার : ভোটার তালিকা থেকে ভোটের ফলাফল প্রকাশ পর্যন্ত ২ শতাধিক কাজের ফর্দ তুলে ধরা হয় ইসির রোডম্যাপে। আইনশৃঙ্খলা ও নির্বাচনি কাজে সশস্ত্র বাহিনীর সহায়তার কথাও তুলে ধরা হয়। সচিব জানান, ভোটের আট-দশ দিন আগে স্বচ্ছ ব্যালট পেপারসহ আনুষঙ্গিক সামগ্রী আনা-নেওয়ায় বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার সরবরাহের বিষয়ে যোগাযোগ করা হবে। প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতির নির্দেশনা দেওয়ায় এ মুহূর্তে গণভোট, গণপরিষদ নির্বাচনের বিভিন্ন দাবির বিষয়ে ইসির কোনো এখতিয়ার নেই বলে জানান সচিব।
ডিসেম্বরের দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় সপ্তাহে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল হতে পারে, এমন আভাস ইসির রোডম্যাপে রয়েছে। তফসিল ঘোষণার এক মাস আগে আইনশৃঙ্খলার খাতওয়ারি বিষয়ে বাহিনী প্রতিনিধিদের সঙ্গে ১৬-২০ নভেম্বর বৈঠকের পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত ‘রোডম্যাপে’ ফেব্রুয়ারির ভোটের ও ডিসেম্বরে তফসিল ঘোষণার তারিখ না দিলেও ডিসেম্বরের দ্বিতীয় বা তৃতীয় সপ্তাহে তফসিল ঘোষণার আভাস রয়েছে। ইসির কর্মপরিকল্পনায় রয়েছে ইলেকটোরাল ইনকোয়ারি কমিটির প্রশিক্ষণ শেষের পরিকল্পনা ২৫ ডিসেম্বর, এ কমিটি তফসিল ঘোষণার পরপরই আইনবিধি প্রতিপালনে কাজ করবে। আর দফাওয়ারি বাজেট প্রস্তাব প্রণয়নে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিনিধিদের বৈঠক তফসিল ঘোষণার এক মাস আগে ১৬ থেকে ২০ নভেম্বরে করার কর্মপরিকল্পনা সূচি রয়েছে।
বিটিভি-বেতারে প্রচার ও দলীয় প্রধানের বক্তৃতা : রাজনৈতিক দলের নির্বাচনি প্রচারে সহায়তা করবে নির্বাচন কমিশন। আর এটা করবে ডিসেম্বরে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর। কর্মপরিকল্পনায় বলা হয়েছে, তফসিল ঘোষণার পরে বাংলাদেশ বেতার এবং টেলিভিশনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নির্বাচনি প্রচার এবং দলীয় প্রধানের বক্তব্য দেওয়ার জন্য চিঠি পাঠাবে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুসারে বিটিভি এবং বাংলাদেশ বেতারের সম্প্রচার বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়া প্রচার করতে পারবে।
আসনভিত্তিক সব প্রার্থীকে একমঞ্চে ইশতেহার ঘোষণা : সংসদ নির্বাচনে কোনো একটি সংসদীয় আসনের সব প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে একই মঞ্চ বা প্ল্যাটফর্মে এবং একই দিনে নির্বাচনি ইশতেহার বা ঘোষণাপত্র পাঠ করতে হবে। সংশ্লিষ্ট আসনের রিটার্নিং কর্মকর্তা এ প্ল্যাটফর্মের ব্যবস্থা করবেন। ইসির কর্মপরিকল্পনায় রয়েছে প্রতীক বরাদ্দের পরপর জাতীয় সংসদ নির্বাচনি আসনভিত্তিক রিটার্নিং অফিসাররের তত্ত্বাবধানে একই প্ল্যাটফর্মে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের নিয়ে ভোটার ও অংশীজনদের উপস্থিতিতে নির্বাচনি ইশতেহার পাঠের সুযোগ করে দেবে ইসি, যেখানে সম্পৃক্ত থাকবে জেলা নির্বাচন অফিস।