প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার ও পরিচালক হুমায়ূন আহমেদের ধারাবাহিক নাটক ‘বহুব্রীহি’ বিপুল দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছিল। মধ্যবিত্ত বাঙালির যাপিত জীবনের কাহিনি জীবন্ত হয়ে ধরা দিয়েছিল টিভির পর্দায়। সে নাটকের অন্যতম একটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন শক্তিমান অভিনেতা আলী যাকের। তার ব্যক্তিগত সহকারী মিস এশার ভূমিকায় ছিলেন লাকী ইনাম। মানুষ কেন দিনদিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে- এ সমস্যার সমাধানের উপায় হিসেবে একদিন লাকী ইনাম বলছিলেন, ‘স্যার, কয়েকটি টিয়া পাখি ধরে তাদের একটি কথা শিখিয়ে দেব- ‘মানুষ তোমরা ভালো হও’। বিস্মিত আলী যাকের প্রশ্ন করলেন, তাতে কী লাভ হবে? লাকী ইনাম বললেন, স্যার, এসব টিয়া অন্য পাখিদের কথাটি শেখাবে। তারপর হাজার হাজার পাখি আকাশে উড়বে আর বলবে, ‘মানুষ তোমরা ভালো হও’। এ কথা শুনতে শুনতে মানুষ ভালো হয়ে যাবে।’ উদ্ভট এ পরিকল্পনার কথা শুনে আলী যাকের বললেন, ‘মিস এশা, আমি সাধারণত মেয়েদের প্রতিভায় মুগ্ধ হই না। আজ আপনার প্রতিভায় আমি মুগ্ধ।’ প্রশংসা শুনে আবেগে মিস এশার চোখে জল চলে আসে।
হুমায়ূন আহমেদ তাঁর গল্প-উপন্যাস কিংবা নাটক-চলচ্চিত্রে কিছু না কিছু বার্তা দিতেন, যা মানুষকে সুপথে ফিরিয়ে আনতে পারে, তাদের বিবেককে জাগ্রত করতে পারে। তবে সেসব বার্তা কেউ আমলে নিত কি না সন্দেহ। এ বিষয়ে তাঁর নিজেরও সংশয় ছিল। তাই নব্বইয়ের দশকে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, প্রতিনিয়ত চোখের সামনে ঘটে যাওয়া নানারকম অন্যায়-অবিচার-অনাচার থেকে যে মানুষ শিক্ষা নেয় না, নাটক-সিনেমা দেখে তারা শিখবে? এটা বিশ্বাস করা কঠিন। হুমায়ূন আহমেদের এ উক্তিটি অসংগত নয়। চারপাশে নানারকম অন্যায়-অবিচারের ঘটনা ঘটলেও আমরা তা থেকে শিক্ষা নিই না। প্রতিবাদী হই না।
বিপথে যাওয়া মানুষদের সুপথে ফিরিয়ে আনাতে মিস এশার পরিকল্পনায় তার বস আলী যাকের যতই উচ্ছ্বসিত হোন, তা যে বাস্তবসম্মত নয়, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। ধর্মীয় অনুশাসন, রাষ্ট্রীয় আইন ও শাস্তির ভয় দেখিয়ে যেখানে মানুষকে সঠিক পথে রাখা যায় না, সেখানে পাখিদের বুলিতে তারা সংশোধিত হবে, তা ভাবা অলীক কল্পনা মাত্র। তবে পশু-পাখির কাছ থেকেও আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। যেমন- বিশ্বস্ততা ও প্রভু ভক্তির শিক্ষা নেওয়া যায় কুকুরের কাছ থেকে। আবার স্বজাতির প্রতি মমত্ববোধ ও একতার শিক্ষা নেওয়া যায় বানর এবং কাকের কাছ থেকে। একটি কাককে মেরে ফেললে শ শ কাক এসে কা কা রবে কান ঝালাপালা করে দেয়। আবার একটি বানরকে মেরে ফেলায় শ শ বানর এসে থানা ঘেরাওয়ের ঘটনা এই বাংলাদেশেই ঘটেছে। কিন্তু চোখের সামনে দুর্বৃত্তরা মানুষকে মেরে ফেললেও আমরা নিজেকে নিরাপদ রাখতে চোখ বুজে থাকি। মানুষের এ চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্যের কথা বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন স্টুয়ার্ট মিল বলে গেছেন এক শ ঊনসত্তর বছর আগে। তিনি তাঁর ‘প্রতিনিধিত্বশীল সরকার’ গ্রন্থে মানুষের আত্মকেন্দ্রিকতার উদাহরণ দিতে গিয়ে লিখেছেন, ‘রাস্তার এক পাশে খুন হতে দেখলে মানুষ অন্য পাশ দিয়ে চুপচাপ চলে যায়।’ সুতরাং এটা অনুমান করা যায়, চোখের সামনে অপরাধ সংঘটিত হতে দেখেও আমাদের নীরব থাকার চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য বহুদিনের পুরোনো। বলা নিষ্প্রয়োজন, এত বছর আগে, যখন মানুষে মানুষে সহমর্মিতা ছিল, তখনই যদি এ অবস্থা থেকে থাকে, তাহলে এই স্বার্থপরতার কালে কি তা আশা করা যায়?
স্বাধীনতার পরপরই স্বনামধন্য চলচ্চিত্র নির্মাতা খান আতাউর রহমান নির্মাণ করেছিলেন তাঁর বিখ্যাত সিনেমা ‘আবার তোরা মানুষ হ’। মূলত মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী দেশের অস্থির ছাত্র-যুব-সমাজকে সুস্থধারায় ফিরে আসার আহ্বান ছিল সিনেমাটির মূল বক্তব্য। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমরা ‘মানুষ’ হতে পারিনি। আর সেজন্যই স্বাধীনতার চুয়ান্ন বছর পরও সমাজ থেকে অনাচার-অবিচার, দুর্নীতি-দুষ্কর্ম দূর হয়নি। বরং বেড়েছে। কবি কুসুমকুমারী দাশ তাঁর ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতায় লিখেছেন, ‘‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?/মুখে হাসি, বুকে বল তেজে ভরা মন/... ... ... ‘মানুষ হইতে হবে মানুষ যখন’।’’ কবি কুসুমকুমারী দাশের সেই ‘বড় ছেলে’র প্রচণ্ড অভাব আমাদের সমাজে। কাজে কেউ বড় হতে চায় না। সবাই কথায় বড় হতে চায়। কবি সমাজ বা মানুষের জন্য যে কাজ করার কথা বলেছেন, ক’জন আমরা সে কাজে প্রবৃত্ত হই? প্রশ্ন করলে জবাব পাওয়া যায়, ‘আমি কী করতে পারি? এ নিয়ে ভাবার কত লোক রয়েছে! আমার দরকার কী ওসব নিয়ে মাথা ঘামানোর?’ অথচ কে না জানে, ফোঁটা ফোঁটা বারিবিন্দু সাগর-মহাসাগর গড়ে তোলে। তেমনি একজন একজন করে মানুষের সমষ্টি থেকেই সমাজের সৃষ্টি। সে সমাজের অংশ হিসেবে সমাজকে সুশৃঙ্খল ও নিষ্কলুষ রাখতে ভূমিকা রাখার কথা আমরা ভুলে যাই।
চিন্তাবিদ-প্রাবন্ধিক ডাক্তার লুৎফর রহমান চরিত্র গঠন সংক্রান্ত লেখার জন্য বিখ্যাত। তিনি তাঁর বিভিন্ন লেখায় মানব চরিত্র গঠন এবং মানুষের কর্তব্য কী হওয়া উচিত সে সম্বন্ধে নানা উপদেশমূলক কথা লিখে গেছেন। তাঁর একটি উক্তি ‘তুমি মানুষ, তোমার ভিতরে আত্মা আছে, ইহা বিশ্বাস করাই যথেষ্ট। বিশ্বাস কর, তুমি ছোট নও।’ এই উক্তিতে ডাক্তার লুৎফর রহমান মানুষের বিশালত্বকে বোঝাতে চেয়েছেন। এই বিশালত্ব শারীরিক বা অর্থবিত্তে নয়, মানসিকতায়। যাদের মন বড়, তাদের কর্মকাণ্ড হয় দিগন্ত বিস্তৃত। ব্যক্তি বা পরিবারের গণ্ডি ছাড়িয়ে তা কখনো কখনো ছড়িয়ে পড়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে। একজন বড় মনের মানুষ নিজেকে কখনোই সংকীর্ণতার বেড়াজালে আটকে রাখেন না। তার কাছে মূলমন্ত্র হয়ে দাঁড়ায় কবি কামিনী রায়ের ‘সকলের তরে সকলে আমরা’ কবিতার মর্মার্থ, যাতে কবি বলেছেন, ‘পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি/এ জীবন মন সকলি দাও/তার মতো সুখ কোথাও কি আছে?/আপনার কথা ভুলিয়া যাও। /পরের কারণে মরণেও সুখ/সুখ সুখ করে কেঁদো না আর,/যতই কাঁদিবে যতই ভাবিবে,/ততই বাড়িবে হৃদয়-ভার। /আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে/আসে নাই কেহ অবনী পরে/সকলের তরে সকলে আমরা/প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।’ সেই আঠারো শতকের শেষ অথবা উনিশ শতকের প্রথমার্ধে কবি কামিনী রায় উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, মানুষ যেভাবে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত, মানে বিব্রত রয়েছে, তাতে সৃষ্টিকর্তার মানুষ সৃজনের উদ্দেশ্যই বিফলে যেতে পারে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ছিল তাঁর এ আহ্বান। বর্তমান সময়ে মানুষ যখন আরও বেশি আত্মকেন্দ্রিক, তখন কবি কামিনী রায়ের কবিতা আরও বেশি প্রাসঙ্গিক।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘মানুষ’ কবিতা শুরুই করেছেন এই বাণী দিয়ে- ‘গাহি সাম্যের গান/মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।’ আল্লাহ রব্বুল আল-আমিন তাঁর সৃষ্ট আঠারো হাজার মাখলুকাতের মধ্যে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন সেরা জীব হিসেবে। মানুষ যে কতটা শ্রেষ্ঠ তার প্রমাণ রয়েছে হজরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টির পরে সব ফেরেশতাকে তাঁকে সেজদা করার জন্য আল্লাহর হুকুমের মধ্যে। আমরা অনেক সময় কারও প্রশংসা করতে গিয়ে বলে থাকি- ‘সে মানুষ নয়, ফেরেশতা’ বা ‘ফেরেশতাতুল্য মানুষ’। কথাগুলো সঠিক মনে হয় না। কেননা মানুষ ফেরেশতাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলেই আল্লাহ তাদের আদমকে সেজদা করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। আর আল্লাহর সে হুকুম অমান্য করে জিন থেকে ফেরেশতায় রূপান্তরিত আজাজিল পরিণত হয় ইবলিশ বা শয়তানে। তবে আল্লাহর কাছ থেকে সে মানুষকে ধোঁকা দিয়ে পাপকাজে প্ররোচিত করার ক্ষমতা আদায় করে নেয়। সমাজে সংঘটিত নানা অপকর্মের ফিরিস্তি দেখলেই বোঝা যায়, ইবলিশ তার সে ক্ষমতাকে বেশ ভালোভাবেই প্রযোগ করে চলেছে।
‘আমাদের এই সমাজ আজ কলুষিত’ বলাটা খুব অযৌক্তিক হবে বলে মনে হয় না। মূল্যবোধের অবক্ষয় সমাজকে করে তুলেছে বসবাসের অযোগ্য। এখানে এখন স্বার্থের কারণে একে অপরের গলায় ছুরি চালাতে দ্বিধা করে না। কতিপয় মানুষ কতটা নিচে নেমে গেছে তার প্রমাণ প্রতিনিয়ত আমরা পাচ্ছি সংবাদমাধ্যমে শিশু ধর্ষণ-নির্যাতনের খবরে। মনুষ্যত্বহীন কিছু মানুষ কন্যাতুল্য শিশুর ওপর আদিম বর্বরতায় ঝাঁপিয়ে পড়তে দ্বিধা করে না। পশুত্ব যাদের বিবেককে গ্রাস করে, তাদের বিবেক জাগিয়ে তোলা মানুষের সাধ্যাতীত।
গোটা সমাজ দেহ আজ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। চীনা প্রবাদে বলা হয়- ‘মাছের পচন শুরু হয় মাথা থেকে’। প্রবাদটির উৎপত্তি চীনে হলেও এর ব্যাপ্তি জগৎজুড়ে। মাছের পচন আসলে মাথা থেকেই শুরু হয়। মূলত মাথায় থাকে মগজ। সেই মগজে পচন ধরলে তা ধীরে ধীরে পুরো দেহে ছড়িয়ে পড়ে। আজ আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রে মূল্যবোধের যে পচন ধরেছে এবং ক্রমাগত সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে, তা শুরু হয়েছে ওপর থেকেই। সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের যারা কর্ণধার, তারা যখন নীতি-নৈতিকতাকে থোড়াই পরোয়া করে যা খুশি করেন, তখন আম-জনতার ‘মহাজ্ঞানী মহাজন যে পথে করে গমন’ কবিতার এই পঙ্ক্তিকে শিরোধার্য করে একই পথের পথিক বনে যাওয়াটা বিচিত্র কিছু নয়।
মানুষ তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাবে বলে যে আশাবাদ কবিগুরু ব্যক্ত করেছেন, আমরাও সে আশায় বুক বাঁধতে চাই। যে কদর্যতার ডোবায় মনুষ্যত্ব আজ নিমজ্জিত, তা থেকে তাকে উদ্ধার করে পুনর্বাসিত করতে হবে স্বমহিমায়। আর তা করতে হবে মানুষকেই। বহুব্রীহি নাটকের টিয়া পাখি নয়, মানুষকেই বলতে হবে- ‘হে মানুষ তোমরা ভালো হও, আমরা মানুষ হই’।
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক