উচ্চ সুদের হার আর রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বিনিয়োগে স্থবিরতা চলছে। তার সরাসরি প্রভাব পড়েছে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহে। গত আগস্ট মাসে দেশের বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরে। ওই মাসে এই প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়িয়েছে ৬.৩৫ শতাংশে, যা গত জুলাইয়ে ছিল ৬.৫২ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৩ সালের পর এটাই সবচেয়ে কম ঋণ প্রবৃদ্ধি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, ব্যাবসায়িক অনিশ্চয়তা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, জ্বালানি সংকট এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কড়াকড়ি মুদ্রানীতির কারণে বিনিয়োগ চাহিদা মারাত্মকভাবে কমে গেছে। ফলে ব্যাংকগুলো নতুন ঋণ বিতরণে আগ্রহ হারাচ্ছে, আবার উদ্যোক্তারাও নতুন বিনিয়োগে ঝুঁকি নিতে চান না।
ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, সরকার পরিবর্তনের পর ব্যাবসায়িক পরিবেশে যে অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়েছে, তা বিনিয়োগ সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করছে। দেশের অনেক প্রভাবশালী উদ্যোক্তা ও বড় ঋণগ্রহীতা বর্তমানে অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন, কেউ কেউ বিদেশে অবস্থান করছেন। ফলে বাজারে নতুন প্রকল্পে ঋণের চাহিদা কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রা সরবরাহ সীমিত করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাড়ানো হয়েছে ঋণের সুদহার।
এতে একদিকে ঋণ নেওয়া ব্যয়বহুল হয়েছে, অন্যদিকে ব্যাংকগুলোর ঝুঁকি ব্যবস্থাপনাও কঠোর হয়েছে। বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহেও ঘাটতি থাকায় শিল্প খাতের উৎপাদন সম্প্রসারণে উদ্যোক্তারা এখন পিছিয়ে আছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, আগস্ট শেষে বেসরকারি খাতে ঋণের মোট স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা, যা জুলাই মাসের ১৭ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকার তুলনায় সামান্য বৃদ্ধি। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধির হার নামমাত্র পর্যায়ে নেমে এসেছে।
এ বছরের ফেব্রুয়ারিতেই ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে ৬.৮২ শতাংশে নেমেছিল, যা তখনো ছিল নিম্নতম স্তর। তবে আগস্টে তা আরো কমে নতুন রেকর্ড গড়েছে।
গত বছরের ডিসেম্বরেও প্রবৃদ্ধি ছিল ৭.২৮ শতাংশ, জানুয়ারিতে কমে ৭.১৫ শতাংশ এবং ফেব্রুয়ারিতে ৬.৮২ শতাংশে নেমে আসে। পরে মে মাসে সামান্য বেড়ে ৭.১৭ শতাংশে দাঁড়ালেও আবার ধীরগতি ফিরে আসে আগস্টে।
বিশ্লেষকরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, করোনাভাইরাসের ভয়াবহ সময়েও বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ৭.৫ শতাংশের নিচে নামেনি। তখন ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় স্থবির থাকলেও সরকার প্রণোদনা প্যাকেজের মাধ্যমে বাজারে টাকার প্রবাহ বজায় রেখেছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক ও নীতিগত অনিশ্চয়তার কারণে এমন কোনো প্রণোদনা নেই, বরং অর্থনীতিতে কঠোরতা বাড়ছে। ২০২১ সালের মে মাসে প্রবৃদ্ধি একবার ৭.৫৫ শতাংশে নেমেছিল, কিন্তু পরের মাসেই আবার বেড়ে ৮.৩৫ শতাংশে উঠে আসে। এবার এমন কোনো পুনরুদ্ধারের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ব্যাংকিং খাতের সংকট এবং অর্থনৈতিক আস্থার অভাব এই প্রবৃদ্ধি পতনের মূল কারণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর মুদ্রানীতি হয়তো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে, কিন্তু তা অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিকে আরো মন্থর করে দিচ্ছে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, ব্যবসায়ীরা এখন বিনিয়োগে ঝুঁকি নিতে ভয় পাচ্ছেন। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না আসা পর্যন্ত ঋণ প্রবৃদ্ধি আরো কমতে পারে।