রাজনৈতিক অস্থিরতা, অনিশ্চিত ব্যাবসায়িক পরিবেশ আর অবকাঠামোগত দুর্বলতার ঘূর্ণাবর্তে থমকে দাঁড়িয়েছে অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের স্বপ্ন। লাখো মানুষের কর্মসংস্থান আর শিল্পায়নের মহাপরিকল্পনা অনেকটাই ফিকে হয়ে আসছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যে উঠে এসেছে এক অপ্রত্যাশিত চিত্র—গেল মার্চ প্রান্তিকে অর্থনৈতিক অঞ্চলে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে মাত্র এক লাখ ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৯৩.৪৬ শতাংশ কম। বিনিয়োগ কমার পাশাপাশি বিনিয়োগ তুলে নেওয়ার প্রবণতাও বেড়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আস্থাহীনতা আর অনিশ্চয়তার এই দীর্ঘ ছায়া দেশের প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের ভবিষ্যেক হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
অর্থনৈতিক অঞ্চলেও এফডিআই নেতিবাচক : দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি এখন আস্থার সংকটে ভুগছে, যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে অর্থনৈতিক অঞ্চলে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) ওপর। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গেল মার্চ প্রান্তিকে অর্থনৈতিক অঞ্চলে এফডিআই এসেছে মাত্র এক লাখ ডলার, যা আগের বছরের অক্টোবর-ডিসেম্বরের তুলনায় ৯৩.৪৬ শতাংশ কম। শুধু তাই নয়, গত বছরের প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় দ্বিতীয় প্রান্তিকে এই বিনিয়োগ কমেছে ৮৩.১১ শতাংশ।
উদ্বেগজনকভাবে অনেকেই বিনিয়োগ তুলেও নিচ্ছেন বলে জানা যায়। অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, ব্যাবসায়িক পরিবেশের অবনতি, উচ্চ সুদহার ও করের বোঝা এবং সহায়ক অবকাঠামোর অভাব সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগকে নিরুৎসাহ করছে। এটি নতুন উৎপাদন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে।
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও আস্থার সংকট : অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নতুন বিনিয়োগ না হলে উৎপাদন বাড়বে না এবং কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হবে না—এটাই বাস্তবতা।
তাঁদের মতে, বর্তমানে বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি গভীর আস্থার সংকটে ভুগছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরি বলেন, ‘বিনিয়োগ নেতিবাচক অবস্থায় রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি বিনিয়োগবান্ধব নয়। সামাজিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। এই অবস্থায় বিনিয়োগকারীরা উৎসাহিত হওয়ার কথা নয় এবং হচ্ছেনও না।’ তিনি আরো যোগ করেন, মূলধনী যন্ত্রপাতি ও বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে, যার নেতিবাচক চিত্র ইপিজেডসহ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতেও স্পষ্ট।
ড. মুজেরির বিশ্বাস, ‘যত দিন একটি রাজনৈতিক তথা নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব না নেবে, তত দিন বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হওয়ার কথা, তখন একটি অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার এলে বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশা করি।’
পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ বলেন, ‘রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বাড়ছে এবং এর প্রভাব সরাসরি বিনিয়োগের ওপর পড়ছে। বিনিয়োগের জন্য স্থিতিশীলতা জরুরি।’
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএস) গবেষণা পরিচালক ড. মাহফুজ কবিরও মনে করেন, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং রাজনৈতিক সরকার না আসায় বিনিয়োগকারীরা আস্থা পাচ্ছেন না।
পাতত মাত্র পাঁচটি ইজেডের উন্নয়ন : সারা দেশে সরকারি-বেসরকারি ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইজেড) করার কথা বলেছিল বিগত সরকার। কিন্তু বেশির ভাগ অর্থনৈতিক অঞ্চলে সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত না হওয়ায় আপাতত সরকারি মাত্র পাঁচটি ইজেডের উন্নয়ন করতে চায় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)।
বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) ও বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ সম্প্রতি জানিয়েছেন, ‘এই মুহূর্তে দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির প্রয়োজন নেই। আগামী ১০ বছরে ১০টি তৈরি করা গেলে তা বাংলাদেশের জন্য যথেষ্ট হবে। তবে শুরুতে পাঁচটি ইজেড উন্নয়নে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। আগামী দু-এক বছরে এর বাইরে কাজ করবে না বেজা।’
অপ্রস্তুত প্লট ও অবকাঠামোগত দুর্বলতা : ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন, অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে রাস্তাঘাট, গ্যাস, ইউটিলিটিসহ প্রয়োজনীয় সহায়ক অবকাঠামো সম্প্রসারণ হয়নি। এই অবকাঠামোগত দুর্বলতা বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহ করছে।
ড. মাহফুজ কবির জানান, ‘অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ না করার প্রধান কারণ হচ্ছে সেখানকার প্লটগুলো এখনো প্রস্তুত নয়। এ ক্ষেত্রে যে মডেল অনুসরণ করা হয়েছে তাতে ভুল ছিল। বিশ্বের অন্যান্য দেশে বিনিয়োগকারীদের প্লট রেডি করে দেওয়া হয়, তাঁরা শুধু মেশিনারিজ বসিয়ে উৎপাদন শুরু করেন। কিন্তু বাংলাদেশে এর ব্যতিক্রম দেখা যায়। কিছু অঞ্চলে জমি নিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে বিরোধও সৃষ্টি হয়েছে।’
তিনি দেশের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক অঞ্চল মিরসরাইয়ের উদাহরণ দিয়ে বলেন, সেখানে উদ্যোক্তারা চাহিদা মতো ইউটিলিটি সেবা পাচ্ছেন না, এখনো পানির সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়নি। পানি, গ্যাস কিংবা বিদ্যুৎ না পেলে বিনিয়োগ হবে কিভাবে? বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেছেন। এখন তাঁরা তাঁদের বিনিয়োগ গুটিয়ে নিচ্ছেন।’
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার জন্য অনেকে আসতে চান, কিন্তু এসে যখন অব্যবস্থাপনা দেখেন, তখন তাঁরা বিনিয়োগ অন্য দেশে স্থানান্তর করেন। অর্থনৈতিক অঞ্চলে সেটাই হচ্ছে। একটি পোশাক কারখানা দিতে ৬০-৭০টি অনুমতির প্রয়োজন হয়। সেখানে দীর্ঘ সময় লেগে যায়, যেটা ভিয়েতনাম বা অন্য প্রতিযোগী দেশে লাগে না।
ইপিজেডেও বিনিয়োগ কমেছে : অর্থনৈতিক অঞ্চলের পাশাপাশি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (ইপিজেড) চিত্রও হতাশাজনক। গেল মার্চ প্রান্তিকে ইপিজেডে বিনিয়োগ কমেছে ১৯.৫৯ শতাংশ। অন্যদিকে জুলাই আন্দোলনের পর পরবর্তী ছয় মাসে অর্থাৎ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ইপিজেডগুলোতে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ২২.৩৩ শতাংশ বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ রপ্তানি প্রসেসিং জোন কর্তৃপক্ষ (বেপজা)। তবে বিনিয়োগ কমলেও এই সময় ইপিজেড থেকে রপ্তানি বেড়েছে ২২.৪১ শতাংশ, যেখানে ইপিজেড বহির্ভূত রপ্তানি বেড়েছে ১২.৮৪ শতাংশ।
বেপজার নির্বাহী চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল আবুল কালাম মোহাম্মদ জিয়াউর রহমান জানান, বৈশ্বিক ও দেশের অভ্যন্তরীণ নানা কারণে গত ছয় মাসে ইপিজেডগুলোতে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ২২ শতাংশ কমে গেছে। তবে বিনিয়োগ কমলেও রপ্তানি বেড়েছে। তিনি আশা করেন, সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীরা ইতিবাচক সাড়া দিচ্ছেন এবং বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়বে।
সরকারের কৌশল পরিবর্তন : চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন বলেন, ‘অর্থনৈতিক অঞ্চল নিয়ে আমরা অনেক বড় বড় কথা বলেছি। সরকারের একটা ক্যাপাসিটি আছে। এর বাইরে আরো বড় কোনো প্রকল্প হাতে নিলে যখন সেটা বাস্তবায়ন করা যাবে না, তখন সেই প্রকল্পটির বাস্তবায়নের সময় বাড়তে থাকে। তাহলে অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ কিভাবে বাড়বে? আমাদের আরো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। তিনি স্বীকার করেন এই পরিবর্তন সময় সাপেক্ষ।’
বিনিয়োগ বাড়ানোর উপায় : অর্থনীতিবিদরা দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি উন্নত করার জন্য বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে : রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলা, করহার ও সুদহার যৌক্তিক মাত্রায় আনা, জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করে শিল্পোৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো এবং অবকাঠামো ও নীতি সহায়ক ব্যবস্থার সংস্কার করা।
তাঁদের মতে, বিদেশি বিনিয়োগ একটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি আস্থার সংকটে ভুগছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, নিরপেক্ষ অর্থনৈতিক নীতি ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ ছাড়া এ সংকট কাটানো সম্ভব নয়। এখনই সময় বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে গঠনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণের।
অর্থনীতিবিদরা শুধু বিদেশি নয়, দেশি বিনিয়োগকারীদের জন্যও বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরির পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, বেসরকারি খাতে ঋণের কোনো চাহিদাই নেই, এই স্থবিরতা গত ২০-২২ বছরে দেখা যায়নি। ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করতে, ব্যবসা সহায়ক যে পরিবেশ দরকার সেটা তাঁরা পাচ্ছেন না। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে সুযোগ-সুবিধা আরো বাড়াতে হবে এবং প্রয়োজনে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ বাড়াতে আরো সহায়তা করতে হবে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, ‘গত কয়েক বছর ধরে বিদেশি বিনিয়োগে এক ধরনের স্থবিরতা চলছে। সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও বিনিয়োগের অনুকূল ছিল না। অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারে কিছু সূচকের উন্নতি হয়েছে, যা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সুযোগ তৈরি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কযুদ্ধের কারণে কিছু চীনা বিনিয়োগ বাংলাদেশে আসতে পারে। এসব বিনিয়োগকারী স্থানীয় রুগ্ণ কারখানা অধিগ্রহণ করতে পারেন। জ্বালানি সমস্যার সমাধান, বিনিয়োগ সহায়ক অবকাঠামো উন্নয়ন, লাল ফিতার দৌরাত্ম্য কমানো গেলে বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়ার অনেক সুযোগ আছে। এ জন্য দক্ষ জনশক্তি তৈরি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা জরুরি।’
তিনি বলেন, অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের পরিবেশ দিতে হবে। অর্থনৈতিক অঞ্চলের সমস্যাগুলো টার্গেট করে তা সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। একই সঙ্গে এখানে উদ্যোক্তাদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর জন্য কাজ করতে হবে।
সৌজন্য: কালের কণ্ঠ
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল