রাজধানীর শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজে দেড় দশক ধরে চলেছে আর্থিক অনিয়ম, প্রশাসনিক দুর্নীতি এবং দায়িত্বশীল পদের অপব্যবহার। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ধারাবাহিক লুটপাট চালিয়েছে একটি মহল। একাধিকবার তদন্তে বেরিয়ে এসেছে এসব অপকর্মে জড়িতদের নাম। কিন্তু কখনো কিছুই হয়নি তাদের। উল্টো অনিয়মের প্রতিবাদ জানিয়ে চাকরি হারিয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন পুলিশের তত্ত্বাবধায়নে পরিচালিত এই কলেজের ৬ জন শিক্ষক।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পুলিশ বাহিনীতে কর্মরত শহীদদের স্মৃতি রক্ষা ও তাদের স্মরণে ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজ। মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রায় ১০ হাজার শিক্ষার্থী এখানে পড়াশোনা করেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কলেজটির আর্থিক লুটপাটের মূলে ছিলেন সৈয়দ মনিরুল ইসলাম। ১৯৭৩ সালের বিসিএস পুলিশ ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত এই কর্মকর্তা এডিশনাল ডিআইজি হিসেবে ২০০১ সালে অবসরে যান। এরপরই তিনি শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজের অধ্যক্ষ পদে যোগ দেন। বোর্ডের নিয়মানুযায়ী ৬৫ বছর পূর্ণ হওয়ায় ২০০৯ সালে তিনি অধ্যক্ষ পদ ছাড়তে বাধ্য হন। এ সময় কলেজ থেকে ‘ফেয়ারওয়েল মানি’ নামে ১০ লাখ টাকা পেনশন নেন। কিন্তু কলেজ থেকে বিদায় না হয়ে ‘পরিচালক’ পদ সৃষ্টি করে আরও পোক্ত হয়ে বসেন। নানা কৌশলে কয়েক দফায় তিনি কলেজের প্রায় কোটি টাকা হাতিয়ে নেন।
জানা গেছে, নানামুখী অনিয়মের প্রেক্ষিতে কলেজে অসন্তোষ তৈরি হলে ২০১৮ সালে তৎকালীন এডিশনাল আইজিপি (প্রশাসন) মঈন-উর-রহমান চৌধুরীকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে পুলিশ সদর দফতর। তদন্তে আর্থিক অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমান পাওয়ায় ১০ জন কর্মকর্তা, শিক্ষক ও কর্মচারীর শাস্তির সুপারিশ করা হয়।
এরমধ্যে পরিচালক সৈয়দ মনিরুল ইসলাম, পুলিশ কনস্টেবল প্রিয়তোষ চন্দ্র সরকার ও মো. হাবিবুর রহমানকে লঘু শাস্তি দেওয়া হয়। বাকিরা সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। তারা হলেন- শিফট ইনচার্জ (প্রভাতী) কাজী বদরুজ্জামান, শিফট ইনচার্জ (দিবা) মাহমুদুল হাসান, হিসাবরক্ষক এস এম নাজমুস সাকিব, একাডেমিক অফিসার এস এম আব্দুল মান্নান এবং পরিচালকের ব্যক্তিগত সহকারী মো. কামাল হোসেন।
অন্যদিকে, আর্থিক দুর্নীতির সত্যতা জানতে সাবেক সভাপতি এডিশনাল আইজিপি রুহুল আমিনের নির্দেশে ২০১৯ সালে একটি অডিট ফার্মের মাধ্যমে নিরীক্ষা করা হয়। এতে কলেজের পরিচালক সৈয়দ মনিরুল ইসলাম, সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাহমুদুল হাসান, শিফট ইনচার্জ কাজী বদরুজ্জামান, একাউন্টেন্ট নাজমুস সাকিব, একাডেমিক অফিসার আব্দুল মান্নান ও পরিচালকের ব্যক্তিগত সহকারী কামাল হোসেন দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বলে প্রমাণ মেলে। এরপরই অডিট কার্যক্রম বন্ধে উঠেপড়ে লাগে এই চক্র। এ সময় একজন কনস্টেবলকে দিয়ে অডিট উপ-কমিটির শিক্ষক সদস্য মোহাম্মদ এয়াছিন চৌধুরীকে লাঞ্ছিত করা হয়।
এ বিষয়ে এয়াছিন চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কলেজের অডিট উপ-কমিটির সদস্য হিসেবে পুঙ্খানুপুঙ্খ অডিটের জন্য অডিট ফার্মকে সহায়তা করতে চেয়েছিলাম। এ কারণে অর্থ আত্মসাৎকারী চক্র আমার ওপর ক্ষিপ্ত হয়। তারা অডিট কার্যক্রম বানচাল করতে পরিকল্পিতভাবে পুলিশ কনস্টেবল মকবুলকে দিয়ে আমার উপর শারীরিক লাঞ্ছনা করে। এ বিষয়ে বিচার চাইতে গেলে সাবেক সভাপতি অ্যাডিশনাল আইজিপি রুহুল আমিন আমাকে অন্যায়ভাবে অব্যাহতি দেন।’
জানা গেছে, শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনা তদন্তে ৩ জন পুলিশ কর্মকর্তা এবং একজন শিক্ষকের সমন্বয়ে আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তবে এই কমিটির পুলিশ সদস্যরা শুরু থেকেই দুর্নীতিবাজদের পক্ষ নিয়ে সাক্ষীদের হুমকি ও ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করেন বলে অভিযোগ উঠে। কমিটির শিক্ষক সদস্য সায়ফুর রহমান এই উদ্দেশ্যমূলক কর্মকাণ্ডের বিপক্ষে অবস্থান নেন।
পরে তদন্ত কমিটি একটি একপেশে রিপোর্ট তৈরি করলে তিনি দ্বিমত পোষণ করেন। আর এ কারণে তিনিসহ অনিয়মের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া ৬ জন শিক্ষককে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। তারা হলেন- হিসাববিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক সায়ফুর রহমান, সাচিবিক বিদ্যা ও অফিস ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রভাষক মুহাম্মদ কামাল হোসেন, বাংলা বিভাগের প্রভাষক উম্মে জান্নাতুন নাহার, কৃষি শিক্ষা বিভাগের সহকারী প্রভাষক মো. নজরুল ইসলাম, রসায়ন বিভাগের প্রভাষক বিজন মিত্র এবং সমাজকর্ম বিভাগের সহকারী প্রভাষক মোহাম্মদ এয়াছিন চৌধুরী।
শিক্ষক লাঞ্ছনায় গঠিত তদন্ত কমিটির শিক্ষক সদস্য সায়ফুর রহমান জানান, ‘তদন্ত চলাকালে তদন্ত কমিটির পুলিশ সদস্যরা শিক্ষক কর্মচারীকে বিভিন্ন ধরনের হুমকি ও ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদানে বাধ্য করেন। এছাড়া, ২০১৮ সালে মঈন উর রহমান চৌধুরী স্যারের তদন্তের সময় দুর্নীতিপরায়ণ কিছু শিক্ষক-কর্মচারী মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করেন। আমি এ বানোয়াট তদন্ত রিপোর্টে দ্বিমত পোষণ করে স্বাক্ষর করলে আমাকেও চাকরি হতে অব্যাহতি দেওয়া হয়।’
চাকরি থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত আরেক শিক্ষক বাংলা বিভাগের প্রভাষক উম্মে জান্নাতুন নাহার ছিলেন কলেজের গভর্নিং বডির শিক্ষক সদস্য। শুরু থেকেই তিনি আর্থিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। এ কারণে তাকেও অন্যায়ভাবে চাকরি হারাতে হয়।
এ বিষয়ে উম্মে জান্নাতুন নাহার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দুর্নীতিবাজ চক্র তাদের দুর্নীতি ও অনিয়ম চালিয়ে যাওয়ার জন্য আমাকে প্রথমে অন্যায়ভাবে গভর্নিং বডি থেকে অপসারণ করে। এরপর কোন রকম দোষ না পাওয়ার পরও আমাকে চাকুরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। আমাকে যারা অন্যায়ভাবে চাকুরিচ্যুত করেছে বর্তমান প্রশাসনের কাছে তাদের উপযুক্ত শাস্তি চাই। চাকরি ফেরত দিয়ে আমাদের সম্মান যেন ফিরিয়ে দেওয়া হয়।’
চাকুরিচ্যুত আরেক শিক্ষক প্রতিনিধি মুহাম্মদ কামাল হোসেন জানান, ‘প্রিন্সিপাল (অব.) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শেখ শরিফুলসহ দুইজন শিক্ষক প্রতিনিধি গভর্নিং বডির মিটিংয়ে অডিট রিপোর্ট বাস্তবায়নের দাবি জানালে তৎকালীন সভাপতি এসএম রুহুল আমিন দুই জন শিক্ষক প্রতিনিধিকে গভর্নিং বডি থেকে অপসারণ এবং চাকরি থেকে অব্যাহতির ব্যবস্থা করেন।
জানা গেছে, অন্যায়ের শিকার শিক্ষকরা চাকরি ফিরে পেতে উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হন। তাদের রিটের প্রেক্ষিতে আদালত শিক্ষা বোর্ডকে বিষয়টি নিষ্পত্তির নির্দেশ দেন। শিক্ষা বোর্ডের তদন্তে ৬ শিক্ষক নির্দোষ প্রমাণিত হন। ২০২৩ সালে এই শিক্ষকদের পুনর্বহালের নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু কলেজের তৎকালীন সভাপতি অতিরিক্ত আইজিপি মো. রুহুল আমিন তাতে কর্ণপাত না করে উল্টো ভুক্তভোগী শিক্ষকদের ‘জঙ্গি’ মামলায় জড়ানোর হুমকি দেন। অন্যদিকে তৎকালীন আইজিপি আবদুল্লাহ আল মামুন প্রভাব খাঁটিয়ে শিক্ষা বোর্ডের তৎপরতা থামিয়ে দেন বলে ভুক্তভোগী শিক্ষকদের অভিযোগ।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর বিভিন্ন ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ আমলে অন্যায়ের শিকার অনেকেই তাদের অধিকার ফিরে পেয়েছেন। তবে শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজ থেকে অন্যায়ভাবে চাকরি হারানো শিক্ষকরা এখনো ন্যায়বিচার পেতে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। তারা চাকরি ফিরে পেতে প্রধান উপদেষ্টাসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন।
আরও জানা যায়, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষিতে পুলিশ বিভাগে আমূল পরিবর্তন হলেও শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজে এখনো বহাল রয়েছে পুরোনো সিন্ডিকেটের লোকজন। এদের মধ্যে আছেন খোদ ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ জাকির হোসেন। নিয়ম অনুযায়ী কোন ব্যক্তির ছয় মাসের বেশি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে থাকার সুযোগ নেই। কিন্তু জাকির হোসেন তিন বছর ধরে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছেন। তার বিরুদ্ধে অনুমোদনহীন ৬ তলা ভবন নির্মাণ ও টেন্ডার ছাড়া ৮ কোটি টাকার কাজ করার অভিযোগ রয়েছে। এমনকি জালসনদধারী একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা না নিয়ে তাকে স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ জাকির হোসেনকে একাধিকবার ফোন করে ও হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠালেও তার কাছ থেকে কোন সাড়া মেলেনি।
এছাড়া, শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজে দেড় দশকের দুর্নীতির বিষয়ে কলেজটির সভাপতি পদে দায়িত্ব পালন করা সাবেক চার আইজিপি শহিদুল হক, জাবেদ পাটোয়ারী, বেনজীর আহমেদ ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন এবং মো. রুহুল আমিনের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর তাদের মধ্যে কেউ কেউ কারাগারে এবং বাকিরা পলাতক আছেন।
শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজের বর্তমান গভর্নিং বডির সভাপতি বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম। দেড় দশকের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ ও অন্যায়ের শিকার শিক্ষকদের চাকুরি ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে কথা বলার জন্য তার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তা সম্ভব হয়নি। তবে নতুন আইজিপি ইতোমধ্যেই কলেজের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু করেছেন বলে পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে।
বিডি প্রতিদিন/মুসা