তাজুল ইসলাম তাঁর মন্ত্রণালয়ে যেমন ব্যাপক লুটপাট এবং স্বেচ্ছাচারিতা করতেন, তাঁর এলাকায়ও দুর্নীতি এবং সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিল তাঁর মন্ত্রণালয়ের অধীনে দুটি বিভাগ। যে দুটি বিভাগের প্রাত্যহিক কাজে তাজুল হস্তক্ষেপ করতেন না। তাদের সঙ্গে ছিল অভিনব মাসিক লেনদেনের হিসাব। ওই দুই বিভাগের দুই প্রধান ছিলেন সম্পূর্ণ স্বাধীন। কিন্তু এ দুই বিভাগের প্রধানদের মাসিক ভিত্তিতে খুশি করতে হতো তাজুলকে। একটি হলো স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ বা এলজিইডি, অন্যটি ওয়াসা। এ দুটির যাঁরা প্রধান হতেন তাঁদের সঙ্গে মন্ত্রীর স্থায়ী চুক্তি ছিল। চুক্তি অনুযায়ী তাঁরা অর্থ সরবরাহ করতেন তাজুল ইসলামকে। তাজুল ইসলামের যখন যা প্রয়োজন হতো, তা দিতে তাঁরা বাধ্য। এ শর্তে তাজুল ইসলাম এবং তাঁর মন্ত্রণালয় এ দুটি বিভাগের কাজে কোনো হস্তক্ষেপ করতেন না। এলজিইডি বা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ মূলত দেশজুড়ে সড়ক এবং স্থানীয় সরকার উন্নয়নের কাজ করে থাকে। ড. কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠানটির প্রতি দাতাদের বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। সারা দেশে অবকাঠামো ও সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে এ প্রতিষ্ঠানটির ঐতিহাসিক অবদান আছে। কিন্তু গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের সীমাহীন দুর্নীতির কারণে এ প্রতিষ্ঠানটি দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়। এখানে প্রচুর প্রকল্প থাকে এবং এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একটা সময়ে এলজিইডির ভূমিকা ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ করে কামরুল ইসলাম সিদ্দিকীর বিদায়ের পর এটি একটি দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানে রূপ নেয়। আর এটির সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটে যখন তাজুল ইসলাম ২০১৮ সালে মন্ত্রী হন। তাজুল ইসলাম মন্ত্রী হওয়ার পর প্রথম দিকে এলজিইডির বিভিন্ন প্রকল্প এবং কাজকর্মে হস্তক্ষেপ করেছিলেন। তিনি বিভিন্ন কাজের জন্য তাঁর পিএস এবং এপিএসের মাধ্যমে প্রধান প্রকৌশলীর কাছে তদবিরও করেছিলেন। কিন্তু একটা সময় তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী তাজুল ইসলামের সঙ্গে দেখা করেন এবং তাঁর সঙ্গে একটি দুর্নীতির অঘোষিত চুক্তিতে আসেন। তাজুল ইসলামের যখন যেটি দরকার হবে সেটি দেবেন এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী। সে অনুযায়ী এলজিইডি স্বাধীনভাবে কাজ করবে। এর ফলে দুটি ঘটনা ঘটে। প্রথমত তাজুল ইসলাম এলজিইডিতে কোনোরকম হস্তক্ষেপ বন্ধ করে দেন। বরং তাঁর এলাকায় জনসভা, তাঁর বিদেশ যাওয়ার টাকা, তাঁর বাসাবাড়ি নির্মাণ, সংস্কারসহ তাঁর যাবতীয় খরচ এলজিইডি বহন করত। এ ছাড়া বেতনের মতো তাজুল ইসলাম পেতেন মাসিক ঘুষের টাকা। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, তাজুল ইসলাম তাঁর পরিবার, আত্মীয়স্বজন এলজিইডি থেকে ১২টি গাড়ি স্থায়ীভাবে ব্যবহার করত। এ গাড়িগুলোর ড্রাইভারসহ যাবতীয় খরচ এলজিইডি থেকে বহন করা হতো। এমনকি তাজুল ইসলামের রান্নার বাবুর্চির জন্যও একটি পাজেরো গাড়ি বরাদ্দ ছিল। বাবুর্চি ওই গাড়িতে বাজার করতেন, বাড়ি যেতেন, এমনকি নিজের গ্রামের বাড়িতে বেড়াতেও যেতেন। অনুসন্ধানে দেখা যায়, তাজুল ইসলাম মন্ত্রী হওয়ার পর ২০১৮, ২০১৯ এবং ২০২১ সালে মোট ছয়বার উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে গেছেন। প্রতিবারই চিকিৎসার যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করে এলজিইডি। মজার ব্যাপার হলো, প্রতিবারই তাজুলের সিঙ্গাপুর যাওয়ার পরদিনই এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলীও সিঙ্গাপুর গেছেন। তাজুল ইসলাম এবং তাঁর স্ত্রীর চিকিৎসার যাবতীয় বিল পুরোটাই তৎকালীন এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী পরিশোধ করেছেন। ওই সময় সিঙ্গাপুর মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের প্রতিটি বিলের বিপরীতে তৎকালীন এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলীর স্বাক্ষর আছে। এভাবে এলজিইডিকে নিজের ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন তাজুল। শুধু যখন এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী নিয়োগ হবে, তখন তাজুল ইসলাম সেখানে হস্তক্ষেপ করতেন এবং তিনি তাঁর পছন্দের ব্যক্তিকে এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী পদে বসাতেন। যেন মাসিক চুক্তিতে কোনো ঝামেলা না হয়।
বিভিন্ন দায়িত্বশীল সূত্র বলছেন, এলজিইডির সর্বশেষ প্রধান প্রকৌশলী হয়েছিলেন আলী আক্তার হোসেন। তাঁকে প্রকৌশলী করার জন্য তাজুল ইসলাম ১০ কোটি টাকা নিয়েছিলেন বলেও এলজিইডি ভবনে প্রকাশ্য আলোচনা হয়। এ সময় শুধু তাজুল ইসলামের পরিবার নয়, তাঁর আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব যাদেরই বিভিন্ন ধরনের বিয়ে বা অন্যান্য অনুষ্ঠান হতো সেখানে এলজিইডির হলগুলো ব্যবহার করা হতো। এ ছাড়া তাজুল ইসলাম এলজিইডিকে ব্যবসায়িক কাজেও ব্যবহার করতেন। তাঁর স্ত্রী পার্বত্য চট্টগ্রামে যে বিপুল জমি কিনেছিলেন, সে জমির উন্নয়ন এবং সংলগ্ন রাস্তা নির্মাণ, চট্টগ্রামে বাড়ি নির্মাণের যাবতীয় খরচ এলজিইডি বহন করেছে। চট্টগ্রামে যখন তাজুলের স্ত্রীর বাড়ি নির্মাণ করা হয়, তখন এলজিইডির প্রকৌশলীরা সেখানে থেকে সমস্ত কাজের তদারকি করেছেন। এভাবেই এলজিইডি পরিণত হয়েছিল তাজুল ইসলামের ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে। তাজুল ইসলাম নিজে তাঁর ঘনিষ্ঠজনকে বলতেন, ‘এলজিইডি আছে জন্যই আমার মন্ত্রণালয় এবং বাসার কোনো খরচ নেই। সব খরচ এলজিইডি বহন করে।’ আর এ কারণেই এলজিইডি ছিল তাঁর কাছে একটা ‘সোনার খনি’। আর এ সুযোগে একটি চমৎকার প্রতিষ্ঠান আস্তে আস্তে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। একসময় যে প্রতিষ্ঠানটির প্রশংসা ছিল দাতাদের কাছে, তাজুলের কারণে তা দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়।
তবে একটি সোনার খনিতে সন্তুষ্ট থাকার লোক তাজুল ইসলাম নন। এলজিইডির ঘুষের টাকায় তাজুলের সবকিছু ঠিকঠাকমতো চললেও তাঁর লোভ ছিল ওয়াসার দিকে। ওয়াসার রাজত্ব ছিল তাকসিম এ খানের হাতে। ২০০৯ সালে একক কর্তৃত্ববলে শেখ হাসিনা তাঁকে ওয়াসার এমডি হিসেবে নিয়োগ দেন। এরপর আওয়ামী লীগের মতোই জোর করে টানা ১৫ বছর ওয়াসার এমডি ছিলেন তাকসিম। ইচ্ছামতো লুটপাট করেছেন। তাকসিমের খুঁটির জোর এতই শক্ত ছিল যে স্থানীয় সরকার মন্ত্রীদেরও তিনি পাত্তা দিতেন না। তাজুল এটা বুঝতে পেরেই তাঁর সঙ্গে ঘুষের সমঝোতা করেন। তাজুল জানতেন, তাকসিমের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে লাভ নেই, বরং যা পাওয়া যায় তা-ই লাভ। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব যখন খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে দেওয়া হয়েছিল, তখন তিনি ওয়াসার এমডিকে সরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার দ্বারা বাধাগ্রস্ত হয়ে তিনি সে চিন্তা থেকে সরে আসেন। ফলে তাকসিম খান হয়ে ওঠেন আরও দুর্বিনীত। তাজুল ইসলাম চতুর মানুষ। অতীত মন্ত্রীদের তাকসিমকেন্দ্রিক তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে তিনি শিক্ষা নেন। তিনি জানতেন তাকসিমের খুঁটির জোর কোথায়। আর এ কারণেই যখন তাজুল ইসলাম স্থানীয় সরকার মন্ত্রী হন, তখন তিনি তাকসিম খানকে ডেকে নিয়ে আসেন এবং তাঁর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় আসেন। তাকসিমও তাঁর ঝামেলাহীন লুটপাটের জন্য মন্ত্রীর সঙ্গে সমঝোতায় আগ্রহী ছিলেন। ফলে তিনি তাজুলকে আশ্বস্ত করেন, ওয়াসার পক্ষ থেকে মন্ত্রীকে এককালীন উপঢৌকন দেওয়া হবে। যেমন বলা তেমন কাজ। তাকসিম তাজুলকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তিনটি বাড়ি উপঢৌকন দেন। তাকসিম খান যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ছিলেন এবং তাঁর পরিবার সেখানে বসবাস করত, তাজুল ইসলাম তাঁকে অনুরোধ করেন যেন যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর জন্য কিছু সম্পদ কিনে দেওয়া হয়। তাকসিম এ শর্তে রাজি হন। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে, ফ্লোরিডায় তিনটি বাড়ি রয়েছে তাজুল ইসলামের। যে বাড়িগুলো কেনা হয়েছে তাকসিম খানের তত্ত্বাবধানে। এ ছাড়া তাজুলের স্ত্রী এবং সন্তানদের কানাডায় বাড়ি কিনে দিয়েছিলেন তাকসিম। এজন্য তিনি ওয়াসা থেকে ঘুষ নিতেন। ওয়াসার ফাইল গেলেই দ্রুত স্বাক্ষর করতেন তাজুল।
তাকসিম খান ছিলেন তাজুলের বিদেশে বিনিয়োগের প্রধান হাতিয়ার। দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডায় বাড়ি, সম্পদ কেনা এবং বিনিয়োগ ইত্যাদি তত্ত্বাবধান করতেন তাকসিম খান। যে কারণে তাকসিম খানের বিরুদ্ধে ওয়াসার কেউ কথা বললে বা কোনো সিদ্ধান্ত নিলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিতেন তাজুল ইসলাম। তাজুল ইসলাম মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে তাকসিম খান হয়ে উঠেছিলেন সবকিছুর ঊর্ধ্বে। এমনকি ওয়াসার তৎকালীন চেয়ারম্যান যখন তাকসিম খানের বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন, তখন তাজুল ইসলাম চেয়ারম্যানকে মুহূর্তের মধ্যে সরিয়ে দিতেও কার্পণ্য করেননি। অনুসন্ধানে দেখা যায়, এলজিইডি এবং ওয়াসার মাধ্যমে তাজুল ইসলাম দুর্নীতির নবরূপ দিয়েছিলেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশে তাজুলের সম্পত্তি জব্দ করা হলেও তাঁর বিদেশে সম্পদ উদ্ধারের জন্য এখন পর্যন্ত সরকার কোনোরকম ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এটি যদি না করা হয় তাহলে তাজুলের দুর্নীতির গভীরতা এবং অবৈধ সম্পদ সম্পর্কে কখনোই জানা যাবে না।