একসময় ফুটবলে ছিল তারকার ছড়াছড়ি। ঘরোয়া লিগ খেলেই দেশব্যাপী পরিচিত হয়েছেন পিন্টু, সান্টু, সালাউদ্দিন, টিপু, হাফিজ, অমলেশ, চুন্নু, আসলাম, মহসিন, মোনেম মুন্না, কায়সার হামিদ, কানন, খোরশেদ, বাবুল, জনি, সাব্বির, নকিব, আলফাজ। কতজন যে তারকাখ্যাতি পেয়েছেন তা হিসাব মেলানো মুশকিল। কালের বিবর্তনে এখন তারকা তো দূরের কথা অনেক ফুটবলারকে অনেকে চেনেনই না। জামাল ভূঁইয়া, তপু বর্মণ, রকিবরা মোটামুটি পরিচিত হলেও বাকিদের চিনতে হয় জার্সি নম্বর দেখে। পুরুষ ফুটবলে তারকার সংকট থাকলেও ক্রিকেটে অনেকের নাম দর্শকদের হৃদয়ে গাঁথা হয়ে গেছে। সত্যিই বলতে কি, অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল দেশের ক্রীড়াঙ্গনে তারকা বলতে শুধু ক্রিকেটারদেরই বোঝাত। মানের অবনতি ঘটায় ফুটবল থেকে অনেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল।
হামজা, সামিতদের মতো মানসম্পন্ন প্রবাসী খেলোয়াড় জাতীয় দলে খেলায় ফুটবলে আগের চেয়ে প্রাণসঞ্চার হয়েছে ঠিকই। পুরুষ ফুটবলে স্থানীয়দের মধ্যে কেউ তেমন আলোচিত নন। তবে জনপ্রিয় এ খেলায় তারকার সংখ্যা একেবারে কম নয়। আর তা নারী ফুটবলারদের ঘিরে। তারকা বা পরিচিত মুখ বলতে নারী ফুটবলারদের নামই এখন উচ্চারিত হচ্ছে। ভাবা যায়, যারা ফুটবলে ঠিকমতো পা চালাতে পারত না বলে তিরস্কার করা হতো। তারা এখন দেশ ছাড়িয়ে এশিয়ান ফুটবলে আলোচিত। যেভাবে এগোচ্ছে তা ধরে রাখতে পারলে বিশ্বেও তাদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়বে। এমনটি হওয়ার পেছনে মেয়েদের লাগাতার সাফল্যই বড় কারণ।
পুরুষরা যেখানে ব্যর্থতার বৃত্তে বন্দি, সেখানে জাতীয় ও বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্টে মেয়েরা সাফল্যের জয়গান গেয়ে যাচ্ছে। অথচ নারী ফুটবলের শুরুটা দীর্ঘদিনের নয়। ২০০৩ সালেই মেয়েরা ফুটবলে যাত্রা শুরু করেছিল। এতে কত প্রতিকূলতা। মেয়েরা ফুটবল খেলবে, একশ্রেণির লোক তা মেনে নিতে পারছিলেন না। মাঠে হাঙ্গামা, কত কিছুই না ঘটেছিল। তবু থেমে থাকেননি মেয়েরা। ভয়কে জয় করে এতদূর এসেছেন। সংখ্যার দিক দিয়ে এতটা কম ছিল যে, কিছুদিন আগেও নারী ফুটবলার বলতে শুধু কলসিন্ধুর মেয়েদের বোঝাত। এখন তো দেশজুড়েই তাদের আলোচনা।
বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্ট দিয়েই মেয়েদের স্বপ্নযাত্রা শুরু। গোলের পর গোল করে একের পর এক শিরোপা জিতেছেন জুনিয়রা। এ জুনিয়ররাই যে মাঠ কাঁপাবেন কে জানত। নারী ফুটবলে বড় সাফল্যটা আসে ২০২২ সালে।
সাফ সিনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপ ভারতের সম্পত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাদের জাতীয় দল ছাড়া অন্যরা শিরোপা জিতবে তা ছিল স্বপ্ন। সেই স্বপ্নের ট্রফি এখন বাংলাদেশের ঘরে। ২০২২ সালে প্রথম সাফ জিতে দক্ষিণ এশিয়া কাঁপিয়ে দিয়েছিল মেয়েরা। শতভাগ জয়ের সাফল্য নিয়ে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয় জাতীয় দল। ২০২৪ সালেও শিরোপা জয়। এমন সাফল্যে রাতারাতি নারী ফুটবলে সুপারস্টার বনে যান অধিনায়ক সাবিনা খাতুন। পেয়ে যান মেয়েদের ম্যারাডোনা খ্যাতি। আঁখি খাতুন, তহুরা খাতুন, সানজিদা খাতুন, ঋতুপর্ণা, স্বপ্না রানী, শামসুন্নাহার সিনিয়র ও জুনিয়ররা তারকার খ্যাতি পেয়ে যান। সাফ বিজয়ই তাদের আলোচিত করে তোলে। মেয়েরা বলেছিলেন, এখানেই তারা থেমে থাকবেন না। যাবেন বহু দূর। যেমন কথা তেমন কাজ। একের পর এক প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছেন তারা। আফঈদা খন্দকারের নতুন নেতৃত্বে জাতীয় দল অনন্য উচ্চতায় ঠাঁই পায়। মিয়ানমার জয় করে এশিয়ান কাপ চূড়ান্ত পর্বে জায়গা করে নিয়েছে। পুরো দলই ছিল উজ্জীবিত। কিন্তু ঋতুপর্ণার নাম আলাদাভাবে উচ্চারিত হয়েছে গোলের ক্যারিশমায়। ১৭ দিন পর আবারও আফঈদার নেতৃত্বে আরেকটি শিরোপা জয়। সাফ অনূর্ধ্ব-২০ হলেও এ ট্রফি জয়ও আলোড়ন তুলেছে। সাগরিকার নাম এখন সবার মুখে মুখে। শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে একাই চার গোল করে অল্প বয়সেই তারকা বনে যান। ছেলেরা যা পারেনি তা করে দেখাচ্ছে মেয়েরা। তাই তো তাদের ঘিরেই যত আশা।