দেশে হত্যাকাণ্ডসহ অপরাধ পরিস্থিতি বর্তমানে এক উদ্বেগজনক অবস্থায় পৌঁছেছে। বিশেষ করে তুচ্ছ কারণে বড় ধরনের অপরাধ, মব সহিংসতা বা মফেসিজম বাংলাদেশে অপরাধের একটি নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। অনেকে মনে করেন, মব সহিংসতার মাধ্যমে তারা শাস্তি এড়াতে পারবে, এমনকি তাদের কর্মকাণ্ডকে সামাজিকভাবে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করা হবে। হত্যাসহ মব সহিংসতার ঘটনা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।
আইনের বাইরে গিয়ে কোনো অভিযোগের সমাধান করার চেষ্টা সমাজকে অরাজকতার দিকে নিয়ে যায়। এতে সমাজে ভয় ও উদ্বেগ বাড়ছে।
সমাজ বর্তমানে একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক মতাদর্শের মধ্যে দূরত্ব, মানুষের মধ্যে সহনশীলতা ও সদ্ভাবের অভাব এবং মানবিকতার চর্চার ঘাটতি অপরাধ বাড়ার অন্যতম কারণ।
সমাজে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মনোভাব ও সহনশীলতার শিক্ষা প্রত্যাশিত মাত্রায় উপস্থিত নেই। ফলে তুচ্ছ কারণে সংঘাত, সহিংসতা, এমনকি হত্যার মতো ঘটনা ঘটছে। এই অপরাধের পেছনে সমাজের চলমান রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা, মানুষের মধ্যে দূরত্ব, অসহিষ্ণুতা এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সমন্বয়হীনতার মতো কারণ রয়েছে। এ ছাড়া পারিবারিক প্রেক্ষাপটেও অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পরিবারের সদস্যদের মধ্যে নির্যাতন, মানসিক নিপীড়ন, এমনকি হত্যার ঘটনা বাড়ছে। পারিবারিক বিধি-নীতির বাইরে যাওয়া, অসন্তোষ, বিচ্ছেদ এবং শারীরিক-মানসিক আক্রমণের ঘটনা বাড়ছে। এসব ঘটনা সমাজে অসহিষ্ণুতা ও দূরত্ব বাড়াচ্ছে। অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও বেকারত্ব অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। অনেকে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন, কেউ নতুন কাজের সুযোগ পাচ্ছেন না, আবার অনেকের আয়-ব্যয় নির্বাহের জন্য যথেষ্ট নয়।
এই পরিস্থিতি মানুষকে অপরাধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তবে সমাজকে অপরাধমুক্ত করতে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংস্কারের পাশাপাশি জনগণের মধ্যে সচেতনতা ও শিক্ষার প্রসার অত্যন্ত জরুরি। এই পথেই আমরা একটি নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়ে তুলতে পারি। মানুষের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সহনশীলতা, এবং মানবিকতার চর্চা বৃদ্ধি করা, সঙ্গে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
অপরাধে যুক্ত হয়েছে পেশাদাররা। তারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, অস্ত্রসজ্জিত এবং গ্যাংভিত্তিক। কিশোর গ্যাং থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক অপরাধীদের গ্যাং পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকায় সক্রিয়। এরা মাদক বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, হত্যা, এমনকি রাজনৈতিক মিছিল-মিটিংয়ে ভাড়াটে অপরাধী হিসেবেও কাজ করছে। স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও তাদের স্বার্থে এই গ্যাংগুলোকে ব্যবহার করছে, যা অপরাধপ্রবণতাকে আরো উসকে দিচ্ছে।
অপরাধ নিয়ন্ত্রণে প্রথমত, দ্রুত ও সুষ্ঠু আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সমাজে মানবিক সৌহার্দ্য, সহনশীলতা এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতার শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়া। মানুষকে অপরাধমুক্ত জীবনযাপনের জন্য প্রস্তুত করতে হবে। সমাজে অপরাধীদের কোনোভাবেই গুরুত্ব দেওয়া যাবে না।
অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মাঠ পর্যায়ের পুলিশের মতামত ও বিশ্লেষণকে প্রাধান্য না দিয়ে নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমন্বয়হীনতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এই সমন্বয়হীনতার সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা।
লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ