‘জুলাই-আগস্ট গণ অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় ইমাম হাসান ভূঁইয়া তায়িমকে গুলি করেছিলেন পুলিশের তৎকালীন এডিসি শামীম, ওসি জাকির হোসেন ও এসআই সাজ্জাদুজ্জামান। পরে পুলিশ ভ্যানে করে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে নেওয়া হয় তাকে। সেখানে ভ্যান থেকে মাটিতে নামিয়ে পাঁচ-ছয়জন পুলিশ সদস্য বুট জুতা দিয়ে মাড়িয়ে তায়িমের চেহারা বিকৃত করে ফেলেন।’ গতকাল বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ দেওয়া জবানবন্দিতে এসব কথা বলেন তায়িমের বড় ভাই রবিউল আওয়াল ভূঁইয়া। অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় প্রসিকিউশনের একাদশ সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দিয়েছেন রবিউল। এর আগে প্রসিকিউশনের দশম সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন আশুলিয়া থানার সামনে পুলিশের পিকআপ ভ্যানে পুড়িয়ে হত্যার শিকার আস-সাবুরের বাবা মো. এনাব নাজেজ জাকি। গতকাল দিনের শেষ প্রসিকিউশনের দ্বাদশ সাক্ষী হিসেবে ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দি দেন রাজশাহীতে আন্দোলনে অংশ নেওয়া জসিম উদ্দিন। পরে এই মামলার পলাতক আসামি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন সাক্ষীদের জেরা করেন। মামলার একমাত্র গ্রেপ্তারকৃত সাক্ষী ও রাজসাক্ষী সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন আসামির কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন। এদিন প্রসিকিউশনের পক্ষে ট্রাইব্যুনালে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম, গাজী এম এইচ তামীম, বি এম সুলতান মাহমুদ, আবদুস সাত্তার পালোয়ান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এই মামলায় এখন পর্যন্ত ১২ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। আরও সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আগামীকালের দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের জ্যেষ্ঠ উপপরিদর্শক মো. ময়নাল হোসেন ভূঁইয়ার ছেলে ইমাম হাসান। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পুলিশের গুলিতে গত বছরের ২০ জুলাই ইমাম হাসান ভূঁইয়া তায়িম যাত্রাবাড়ীর কাজলা ফুটওভার ব্রিজের সামনে মারা যান। তায়িম নারায়ণগঞ্জের সরকারি আদমজী সিটি এমডব্লিউ কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন। তায়িমের মৃত্যুর বিষয়ে জবানবন্দিতে তাঁর বড় ভাই সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী রবিউল আওয়াল ভূঁইয়া তাঁর জবানবন্দিতে বলেন, ‘আমার ছোট ভাই ইমাম হাসান তায়িম ভূঁইয়া যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকায় আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল। ১৬ থেকে ১৯ জুলাই পর্যন্ত সে সারা দিন আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। আমার মা তার ব্যাগ নিয়ে কাছাকাছি বসে থাকত। ১৯ জুলাই রাত্রে সরকার কারফিউ জারি করে। ২০ জুলাই দুপুর ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল ছিল। আমার ভাই মাঝে চা খাওয়ার কথা বলে বাইরে গিয়ে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। ওই সময় তাকে আমি দুইবার কল দিয়েছি কিন্তু সে রিসিভ করেনি। আনুমানিক সাড়ে ১২টার দিকে তার ফোনে কল দিলে ফোনটি বন্ধ পাই। আনুমানিক ১২টা ৫০ মিনিটের দিকে আম্মুকে ফোন দিলে আম্মু জানায়, বাড়িওয়ালা মাকে বলেছে যে তায়িম গুলিবিদ্ধ হয়েছে। আমার আম্মা কাজলা ফুটওভার ব্রিজের পাশে তায়িমের জুতা এবং রক্ত দেখতে পায়। সেখানে উপস্থিত লোকজন আমার মাকে জানায় যে আপনার ছেলেকে ভ্যানে করে পুলিশ যাত্রাবাড়ী থানার দিকে নিয়ে গেছে।’
জবানবন্দিতে রবিউল বলেন, ‘আমি তায়িমের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর শুনে আমার খালা মোসাম্মৎ শাহিদা আক্তারকে জানালে সে কান্না করতে করতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যায়। সেখানে খোঁজাখুঁজির পর তায়িমকে না পেয়ে একজন সাংবাদিককে তায়িমের ছবি দেখালে তিনি বলেন যে তায়িমকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়েছে। পরের দিন আমার পিতা গিয়ে সেখান থেকে লাশ গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায় নিয়ে যায়। আমি সিলেট থেকে কুমিল্লা গ্রামের বাড়িতে যাই। সেখানে ২১ জুলাই আনুমানিক রাত ১০টায় তার লাশ দাফন করা হয়। আমার আব্বার কাছ থেকে জানতে পারি যে আমার ছোট ভাইয়ের শরীরে দুই শটির মতো ছররা গুলি লেগেছিল।’ ট্রাইব্যুনালের প্রশ্নের জবাবে সাক্ষী জানান, তাঁর আব্বা পুলিশে চাকরি করেন। ভাইয়ের মৃত্যুর ঘটনার বর্ণনা দিয়ে রবিউল ট্রাইব্যুনালকে বলেন, ‘তায়িমের বন্ধুদের কাছ থেকে জানতে পারি, পুলিশ যখন টিয়ার শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড এবং গুলি করলে সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। তায়িম তার দুইজন বন্ধুসহ লিটনের চায়ের দোকানে আশ্রয় নেয়। পুলিশ সেখান থেকে তাদের তিনজনকে টেনে বের করে এবং বেধড়ক মারধর করে। পুলিশ তাদের গালি দিয়ে দৌড় দিতে বলে। তায়িম প্রথমে দৌড় দেয়। তখন তায়িমের পায়ে একজন পুলিশ সদস্য গুলি করে। সে পেছন ফিরে তাকালে তখন তার শরীরের নিম্নাংশে আরেকটি গুলি করা হয়। গুলিটি সামনের দিকে প্রবেশ করে পেছন দিয়ে বের হয়ে যায়। তায়িমকে শটগান দিয়ে আরও অনেক গুলি করা হয়। তখন তার বন্ধু রাহাত তাকে পেছন দিয়ে ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল বাঁচানোর উদ্দেশ্যে। তখন পুলিশ রাহাতকেও গুলি করে এবং তাকে বাধ্য করে তায়িমকে ফেলে রেখে যেতে।’ তিনি বলেন, ‘রাহাত চলে যাওয়ার পরও আধা ঘণ্টা পর্যন্ত তায়িম ওখানে পড়ে ছিল। তায়িম ওখানে পড়ে কাতরাচ্ছিল এবং আকুতি করছিল আমাকে বাঁচান বাঁচান বলে। সাংবাদিকসহ উপস্থিত অনেকেই তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিতে চেয়েছিল কিন্তু পুলিশ সদস্যরা তাকে নিতে দেয়নি। বরং তারা তার মৃত্যু উপভোগ করছিল। ওখান থেকে ২০ গজের মধ্যে রাস্তার দুপাশে দুটি হাসপাতাল ছিল। আধা ঘণ্টা পরে পুলিশ ভ্যানে করে তাকে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে নিয়ে ভ্যান থেকে মাটিতে নামিয়ে পাঁচ-ছয়জন পুলিশ বুট জুতা দিয়ে তাকে মাড়িয়ে তার চেহারা বিকৃত করে ফেলে। তাদের মধ্যে ছিল এডিসি শামীম, এডিসি মাসুদুর রহমান মনির, এসি নাহিদ। পরে কেউ তাকে ভ্যানযোগে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করে।’
সাক্ষী রবিউল জবানবন্দিতে বলেন, ‘যাত্রাবাড়ী থানার তৎকালীন সাব-ইন্সপেক্টর সাজ্জাদুজ্জামান প্রথম পায়ে গুলি করে। পরে এডিসি শামীম আরেকজনের হাত থেকে অস্ত্র নিয়ে তায়িমের শরীরের নিম্নাংশে গুলি করে। তারপর ওসি তদন্ত জাকির হোসেন অনেকবার গুলি করে। ঘটনাস্থলে তখন জয়েন কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, জয়েন কমিশনার প্রলয়, ডিসি ইকবাল, এডিসি মাসুদুর রহমান মনির, এসি নাহিদ, এসি তানজিল, ওসি আবুল হাসান, ওসি অপারেশন ওয়াহিদুল হক মামুনসহ ১০-১৫ জন পুলিশ সদস্য ছিল। ২৬ জুলাই আমি আমার ভাইয়ের হত্যাকাণ্ডসংক্রান্ত ভিডিও বিভিন্ন চ্যানেল ও সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখি।’
সাক্ষী বলেন, ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিবের নির্দেশে আমার ভাইসহ আন্দোলনকারী প্রায় দুই হাজার ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়। আমি তাদের ফাঁসি চাই।’
টি-শার্টের পোড়া অংশ ও সিমকার্ড দেখে আস-সাবুরের লাশ শনাক্ত করি : ৫ আগস্ট আশুলিয়া থানার সামনে পুলিশের পিকআপ ভ্যানে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয় ছয়জনকে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন আস-সাবুরও। তাঁর বাবা মো. এনাব নাজেজ জাকি গতকাল ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়ে চেয়েছেন ছেলে হত্যার বিচার। অবসরপ্রাপ্ত গার্মেন্ট কর্মকর্তা ৬০ বছর বয়সি এনাব নাজেজ জাকি জবানবন্দিতে বলেন, ‘৫ আগস্ট সকাল ১০টার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে মিছিলে গিয়েছিল আস-সাবুর। সকাল আনুমানিক সাড়ে ১১টার দিকে মিছিলটি বাইপাইলে আসে। তখন সে আমার বড় ছেলে রেজোয়ানকে ফোন দিয়ে জানায় যে সে মিছিলে আছে। আনুমানিক সাড়ে ১২টার দিকে আবার তার বড় ভাইকে ফোন দেয়। জানায়, এখানে অনেক লোক গুলিবিদ্ধ হচ্ছে এবং পড়ে যাচ্ছে। তার ভাই তাকে সেখান থেকে চলে আসতে বলে। কিন্তু সে আসে না। বিকাল ৪টার পর থেকে তার মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়। সেদিন আমার ছেলে আর ফেরত আসেনি।’
সাক্ষী তাঁর জবানবন্দিতে বলেন, ‘পরদিন ৬ আগস্ট বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে আমার ছেলেকে অনেক খোঁজাখুঁজি করি। দুপুর সাড়ে তিনটার দিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমরান নামক একজন সমন্বয়ক আমার বড় ছেলেকে জানায়, আশুলিয়া থানার সামনে কয়েকটা পোড়ানো লাশ রয়েছে, সেখানে আপনার ভাইয়ের লাশ আছে কিনা এসে শনাক্ত করেন। রেজোয়ান কান্নায় ভেঙে পড়ে। আমার ভাগনে হুমায়ন কবিরকে ঘটনাস্থলে পাঠাই। তার সঙ্গে আমার দূরসম্পর্কীয় খালাতো ভাই মেহেদী হাসান ছিল। তারা আমার ছেলে আস-সাবুরকে তার পরিধেয় টি-শার্টের পোড়া অংশ এবং মোবাইলের সিম দেখে তাকে শনাক্ত করে। লাশের সঙ্গে থাকা মোবাইল থেকে সিমটি বের করে অন্য একটি মোবাইলে সংযুক্ত করার পর দেখা যায় ওই সিমটি আমার ছেলে আস-সাবুরের।’ তিনি বলেন, ‘সেনাবাহিনী এবং ছাত্ররা পোড়ানো ছয়টি লাশের জানাজা করে সন্ধ্যা ৬টার দিকে। লাশ আমাদের কাছে হস্তান্তর করে। আমি আমার ছেলের লাশের দিকে একনজর তাকিয়েছি, কিন্তু তার চেহারা এমন বীভৎস অবস্থায় ছিল তাকে চেনার কোনো উপায় ছিল না। দ্বিতীয় জানাজা শেষে রাত ৮টার দিকে তার লাশ নিয়ে আমরা আমাদের গ্রামের বাড়ি নওগাঁ জেলার মহাদেবপুরে নিয়ে যাই। পরের দিন ৭ আগস্ট সকাল ৯টায় তৃতীয় জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হয়।’
এই ঘটনার জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনসহ পুলিশের সংশ্লিষ্টদের দায়ী করে তাদের বিচার দাবি করেন এই সাক্ষী। বলেন, যেভাবে তাঁর ছেলেকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে, আসামিদেরও সে ধরনের শাস্তি হোক।