অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে বাংলাদেশ ব্যাংককে পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানিয়েছেন দেশের শীর্ষ অর্থনীতিবিদরা। তবে তারা সতর্ক করেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় এসে এ উদ্যোগের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ না হলে সংস্কার কার্যকর হবে না; কেবল কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ থাকবে। গত সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক অধ্যাদেশ (সংশোধন) ২০২৫ খসড়া নিয়ে আরও আলোচনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। উল্লেখ্য, ব্যাংক কোম্পানি আইন দেশের ব্যাংক পরিচালনার মূল আইন, আর বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ভিত্তি আইন।
প্রস্তাবিত সংশোধনীতে কী আছে : আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সুপারিশ অনুযায়ী প্রস্তুতকৃত খসড়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শাসনব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কারের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, গভর্নরের পদকে মন্ত্রিসভার সমমর্যাদায় উন্নীত করা; প্রধান বিচারপতির কাছে শপথ নেওয়ার বাধ্যবাধকতা; দুই স্তরের নিয়োগ প্রক্রিয়া যেখানে সার্চ কমিটি প্রার্থী সুপারিশ করবে, রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে চূড়ান্ত নিয়োগ দেবেন, তবে সংসদীয় অনুমোদন লাগবে; পরিচালনা পর্ষদে গভর্নর, গভর্নরের মনোনীত দুই ডেপুটি-গভর্নর এবং গভর্নরের জমা দেওয়া তালিকা থেকে সরকারের মনোনীত আট পরিচালক অন্তর্ভুক্ত থাকবে; কোনো সরকারি কর্মকর্তা সরাসরি পরিচালনা পর্র্ষদে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন না এবং মনোনীত তালিকার বাইরে কোনো নিয়োগ দেওয়া যাবে না।
রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া বাস্তবায়ন অসম্ভব : গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সরকার রাজনীতিকদের প্রভাব সীমিত করার চেষ্টা করছে। তবে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া এ উদ্যোগ টেকসই হবে না। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক স্বাধীনভাবে কাজ করলে দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো হবে, আর অর্থনীতি ভালো থাকলে রাজনীতিবিদদেরও স্বস্তি থাকবে। তাই রাজনীতিবিদদের বিষয়টি দূরদর্শিতার সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত। তিনি মনে করেন, গভর্নরের নিয়োগ প্রক্রিয়া হতে হবে পেশাদারিত্ব ও সংসদীয় পর্যবেক্ষণনির্ভর। তাতে গভর্নরের পদ সাংবিধানিক মর্যাদার মতো হবে এবং নিরাপত্তা ও জবাবদিহি দুটিই নিশ্চিত হবে।
কাগজে স্বাধীনতা, বাস্তবে নয় : সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকনোমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা বহুদিন ধরে দাবি করা হলেও কেবল আইন দিয়ে তা নিশ্চিত করা যায় না। রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ছাড়া তা কার্যকর হবে না। তিনি বলেন, আমাদের অনেক কমিশন কাগজে স্বাধীনতা পেয়েছে, এমনকি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতাও ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাবে বাস্তবে তা কার্যকর হয়নি। তাই ভবিষ্যৎ সংসদ কর্তৃক এ খসড়ার অনুমোদন অপরিহার্য। তিনি আরও বলেন, ব্যাংক খাতের অন্য আইনগুলোও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতায় বাধা দেয়। সমন্বিত সংস্কার ছাড়া কাঙ্ক্ষিত ফল আসবে না। তবে পুরোপুরি আমলাতন্ত্রকে সরিয়ে দিলে কার্যকর বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। সঠিক ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে।
সক্ষমতা ও জবাবদিহির প্রশ্ন : অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, তিনি নীতিগতভাবে স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে। তবে তার মতে, এটি অর্জন করতে হবে সক্ষমতা, সততা ও দক্ষতার মাধ্যমে। তিনি বলেন, আপনি যদি সক্ষম না হন, শুধু পদে বসে থেকে কোনো লাভ নেই। স্বায়ত্তশাসন মানে সবকিছু ছেড়ে দেওয়া নয়। পৃথিবীর কোনো দেশেই শতভাগ স্বাধীনতা নেই। রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ব্যাংক ও আর্থিক খাত সংস্কার নিয়ে কথা বলেছে এবং তারা মূলত সংস্কার অব্যাহত রাখতে সম্মত হয়েছে।
আইএমএফ শর্তে সংস্কার : সরকার জানিয়েছে, আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে স্বল্পমেয়াদি সংস্কার সম্পন্ন করা হবে। আর মাঝারি ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার করবে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণ কর্মসূচির শর্ত অনুযায়ী, আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে উপদেষ্টা কমিটি দ্বারা খসড়া অনুমোদন এবং ডিসেম্বরের মধ্যে অধ্যাদেশ জারি করতে হবে।