বাংলাদেশের রাজনীতিতে সংকটের মেঘ কাটছে না। এরই মধ্যে সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা শেষ হয়েছে। গত ৩১ জুলাই এই ধাপের ২৩তম দিনের মতো আলোচনা হয়। এর মধ্য দিয়ে মৌলিক সংস্কার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান স্পষ্ট হয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আগেই যে বিষয়গুলোতে ঐকমত্য হয়েছিল, সেগুলো বাদ দিয়ে এই ধাপের আলোচনার জন্য কমিশনের পক্ষ থেকে ১৯টি মৌলিক সংস্কারের বিষয় চিহ্নিত করা হয়। এমনকি এরই মধ্যে জুলাই জাতীয় সনদ বা রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের লক্ষ্যে আনা প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের পদ্ধতি কী হবে, তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। নিজ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত দেবে না জাতীয় ঐকমত্য কমিশন- এমন সিদ্ধান্ত এসেছে। তবে সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভিন্নতা রয়েছে।
ঐকমত্য কমিশন সূত্র জানায়, ১০ আগস্ট জুলাই সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা শুরু হবে। গণমাধ্যমসূত্রে আমরা যে বিষয়গুলো খেয়াল করেছি, তাতে পরিষ্কার হয়েছে যে ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে যেসব দল অংশ নিয়েছে এবং দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরাই অনেক বিষয়ে একমত নয়। এমনকি বিভিন্ন বক্তব্য-বিবৃতির মধ্যেও আমরা সে ধরনের লক্ষণ স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি। বিশেষ করে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরের থেকে ভিন্ন অবস্থানে রয়েছে, সেটি আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়েছে।
রাজনীতিতে যেকোনো সময় যেকোনো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে এমন আলোচনা সর্বমহলে সোচ্চার। গত ৩১ জুলাই রাজধানীর সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে বিএনপি মহাসচিব তাঁদের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ না থাকি, আমরা যদি সতর্ক না থাকি, তাহলে এক-এগারোর মতো ঘটনা ঘটা এখানে অস্বাভাবিক কিছু নয়।’ তিনি বলেন, ‘খুব সতর্ক থাকতে হবে। আমরা কিন্তু খুব একটা সূক্ষ্ম তারের ওপর দিয়ে যাচ্ছি।’ তাঁর এই বক্তব্য থেকেও মনে হয় যে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে রাজনীতিতে এক ধরনের সংকট রয়েছে।
৩১ জুলাই জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের দুপুর ১২টা ১১ মিনিটে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দেওয়া এক পোস্ট নিয়েও বেশ আলোচনা ও বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। তিনি তাঁর ফেসবুক পোস্টে ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় নেতা মো. আবু সাদিক কায়েমেরও সমালোচনা করেন। তিনি লিখেছেন, ‘শিবির নেতা সাদিক কায়েম সম্প্রতি একটা টক শোতে বলেছেন, ছাত্রশক্তির গঠনপ্রক্রিয়ায় শিবির যুক্ত ছিল, শিবিরের ইনস্ট্রাকশনে আমরা কাজ করতাম। এটা মিথ্যাচার।’ নাহিদ তাঁর ফেসবুক পোস্টে দাবি করেন, ‘সাদিক কায়েম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোনো সমন্বয়ক ছিলেন না।...’
অন্যদিকে বাহাত্তরের সংবিধানের চার মূলনীতি বাতিলের প্রচেষ্টার অভিযোগ তুলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভা বর্জন করেছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), জাসদ, বাসদ, বাসদ মার্ক্সবাদী দল। সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘শেষ মুহূর্তে তড়িঘড়ি করে এমন একটি প্রস্তাব পাস করানোর চেষ্টা থেকেই কমিশনের উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে যায়। আগে অনেকে বলেছিলেন, সংবিধান ছুড়ে ফেলে দিয়ে নতুন করে লিখতে হবে, আজ তারই প্রতিচ্ছবি আমরা দেখলাম।’
আমরা জানি যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কার্যক্রম সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ রয়েছে। অন্যদিকে গত ৩০ জুলাই জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও দপ্তর সম্পাদক মাহমুদ আলমের বিরুদ্ধে দলীয় সব ধরনের সাংগঠনিক কার্যক্রমের ওপর অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। আদালত এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির নেতৃত্বের বিরোধ নিয়ে হাইকোর্ট বিভাগে বিচারাধীন থাকা একটি রিট পিটিশনের (১৫০৫১) উল্লেখ করেন। আদালত বলেছেন, ‘মামলাটি বর্তমানে হাইকোর্ট বিভাগের শুনানির জন্য প্রস্তুত অবস্থায় বিচারাধীন। এ পর্যায়ে কারো পক্ষে দলীয় কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করা সমীচীন নয় মর্মে আদালতের নিকট প্রতীয়মান হয়।’
এমন নানা ধরনের মত-ভিন্নমত এবং অনৈক্যের পরিস্থিতি আমাদের ক্রমেই শঙ্কিত করে তুলছে। যেসব রাজনৈতিক দল বর্তমানে মাঠে নেই, তারা তো এমনিতেই মাঠে থাকা রাজনৈতিক দলের বিপক্ষে আছে। আর যেসব দল মাঠে সরব রয়েছে, তারাও যদি পরস্পরের প্রতিপক্ষ হয়ে যায়, কোনো বিষয়ে একমত না হয়ে বিভেদ তৈরি করতে থাকে, তাহলে রাজনীতির সংকট আরো বাড়তে পারে- এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
আমরা চাই, দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। কিন্তু এ বিষয়ে নতুন করে কোনো প্রশ্ন তৈরি হোক, সেটি আমরা চাই না। নির্বাচনের মাধ্যমে যারা ক্ষমতায় আসবে, তারাই চালাবে পাঁচ বছর। সেই পাঁচ বছরে যদি তারা ব্যর্থ হয়, না পারে, আবার নির্বাচন হবে। নির্বাচনে জনতা তাদের বাদ দেবে, অন্য দলকে ভোট দেবে।
আগামী নির্বাচন যদি সত্যি ফেব্রুয়ারিতে হয়, তাহলে সামনের সময়টা খুবই কম। এমনকি যে সময় আছে, তা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং, আর এ ক্ষেত্রে বহুমুখী সংকট থেকেই যাবে- এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। খালি চোখে এখন পর্যন্ত আমরা কোনো চূড়ান্ত ঐকমত্য দেখতে পাচ্ছি না। এমনকি নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপও দেখা যাচ্ছে না।
বহু দেশে নির্বাচনী সংস্কার হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো বারবার কমিটমেন্ট করছে নির্বাচনকে অবাধ ও গ্রহণযোগ্য করে তোলার বিষয়ে। এমনকি এমন কমিটমেন্ট বাংলাদেশেও এর আগে কয়েকবার হয়েছে। তার পরও কোনো না কোনোভাবে নির্বাচন প্রভাবিত হচ্ছে এবং প্রশ্নবিদ্ধও হয়েছে। কাজেই আমরা বাংলাদেশে যে কাঠামোই বাছাই করি না কেন কিংবা যেমন আইনই তৈরি করি না কেন অথবা যেমন সংস্কারই হোক না কেন, এগুলো বাস্তবায়নের মূলে রয়েছে নাগরিক এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মানসিকতার পরিবর্তন। মানসিকতা পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই একটি গ্রহণযোগ্য মানের উদার নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা পেতে পারে।
মোটাদাগে বলা যায়, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার টানাপড়েনের পরিস্থিতি দীর্ঘদিনের। উদার গণতন্ত্রের উপাদানগুলো প্রায় অনুপস্থিত। আর এই দীর্ঘ সময়ের অনুপস্থিত উপাদানগুলোর যথাযথ সংস্কার রাতারাতি সম্ভব নয়। ভবিষ্যতের চলার পথ মসৃণ করতে হলে অতীতের ভুল চিহ্নিত করে শিক্ষা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, নানা প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। আমরা যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নির্মাণ করতে চাই, তার জন্য দরকার আইনের শাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা।
লেখক : অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ