বাংলার ইতিহাসে যারা প্রকৃত জননেতা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন, তাঁদের মধ্যে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক অন্যতম। তিনি ছিলেন একাধারে আইনজ্ঞ, রাজনীতিবিদ এবং নিপীড়িত জনতার অকৃত্রিম অভিভাবক। বাংলার মাটি ও মানুষের মুক্তি, কৃষকের ন্যায্য অধিকার আদায় এবং বৃহত্তর বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও সংগ্রাম কেবল এক কালের বাস্তবতায় আবদ্ধ নয়—আজও বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার সংগ্রামে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ও বার্তা প্রাসঙ্গিক হয়ে আছে।
এ কে ফজলুল হক ১৮৭৩ সালের ২৬ অক্টোবর বরিশালের এক শিক্ষিত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেধার সঙ্গে শিক্ষাজীবন শেষ করেন এবং আইনের স্নাতক হয়ে আইনপেশায় যুক্ত হন। কিন্তু তাঁর জীবন ছিল জনসেবার জন্য নিবেদিত। শুরুর দিক থেকেই তিনি বাংলার কৃষক, শ্রমিক এবং নিপীড়িত মানুষের মুক্তির জন্য রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ শুরু করেন।
তাঁর রাজনৈতিক উত্থান ছিল একেবারে ভিন্নমাত্রার। জমিদার-নওয়াব শ্রেণির সুবিধাভোগী রাজনীতির বাইরে থেকে তিনি বাংলার সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে আবির্ভূত হন। কৃষকসমাজের দুঃখকষ্ট, সামাজিক বৈষম্য এবং ব্রিটিশ শাসনের অবিচার তাঁর রাজনীতির মূল প্রেরণা ছিল।
১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ এ কে ফজলুল হক অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের অধিবেশনে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এই প্রস্তাবের মাধ্যমে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের জন্য পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি জানানো হয়। মূলত, এখান থেকেই পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের রূপরেখা সূচিত হয়, যার অংশ হিসেবেই পরবর্তীকালে বাংলাদেশের জন্ম ঘটে।
শেরে বাংলার প্রস্তাব এক ঐতিহাসিক মাইলফলক ছিল, যা কেবল রাজনৈতিক দাবি নয়—বরং জনগণের আত্মপরিচয়ের আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ছিল। বাঙালি মুসলমানদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়াসে তাঁর ভূমিকা ছিল প্রজ্ঞাপূর্ণ ও দূরদর্শী। তাঁর প্রস্তাব ছাড়াই পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এত দ্রুত দিকনির্দেশনা পেত না।
শেরে বাংলার রাজনৈতিক দর্শনের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু ছিল গ্রামীণ কৃষকসমাজের মুক্তি। সে সময় জমিদারি প্রথার কারণে বাংলার কৃষকরা চরম নিপীড়নের শিকার ছিল। ফসল উৎপাদন করেও তারা ভূমির মালিকানা পেত না, বরং জমিদারদের চরম শোষণের শিকার হতো।
ফজলুল হক 'প্রজাস্বত্ব আইন' (Tenant Rights Act) প্রবর্তনের মাধ্যমে কৃষকদের জমির ওপর অধিকার নিশ্চিত করার চেষ্টা করেন। তাঁর প্রবর্তিত নীতিমালা ও প্রশাসনিক সংস্কার বাংলায় জমিদারি প্রথা দুর্বল করতে বড় ভূমিকা রাখে। তিনি সরাসরি কৃষকের ন্যায্য হিস্যা প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনৈতিক লড়াই করেন এবং কৃষকসমাজের প্রতি প্রশাসনিক ও আইনি সহানুভূতি সৃষ্টি করেন।
এ প্রসঙ্গে ১৯৩৭ সালে তাঁর নেতৃত্বে গঠিত কৃষকপন্থী সরকার জমিদারদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেয় এবং কৃষক বাঁচানোর জন্য একাধিক আইন পাস করে। তাঁর প্রচেষ্টায় বাংলার কৃষকরা প্রথমবারের মতো তাদের মাটির ওপর কিছুটা হলেও অধিকার লাভ করে।
শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শেষভাগে ভারতের দিল্লিকেন্দ্রিক আধিপত্যবাদী নীতির বিপদ গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি স্পষ্টভাবে দেখতে পেয়েছিলেন যে ভারতীয় কেন্দ্রিক রাজনীতি, বিশেষ করে কংগ্রেসের নীতিমালা, বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থকে উপেক্ষা করছে।
তিনি বহুবার সতর্ক করেছিলেন যে, যদি বাংলার জনগণ নিজেদের অধিকার ও স্বতন্ত্রতা রক্ষায় সচেতন না হয়, তাহলে ভারতীয় আধিপত্য বাংলার সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থাকে গ্রাস করে ফেলবে। তাঁর এই অগ্রিম বার্তা আজকের বাংলাদেশের বাস্তবতায় কতটা সত্য তা সহজেই উপলব্ধি করা যায়—বিশেষ করে যখন ভারতীয় ভূরাজনৈতিক আগ্রাসন ও পানিসম্পদ ইস্যুতে বাংলাদেশের স্বার্থ বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেখা যায়।
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে শেরে বাংলার অবদান নতুনভাবে মূল্যায়ন করার সময় এসেছে। কৃষকের অধিকার আদায়, স্বতন্ত্র জাতীয় পরিচয় প্রতিষ্ঠা এবং বৈদেশিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান—এসব আজকের বাংলাদেশের জন্যও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
বিশেষ করে বাংলাদেশের কৃষি নির্ভর অর্থনীতি, জমি সংস্কার প্রশ্নে ন্যায্য বণ্টন, এবং জলসম্পদ ও সীমান্ত নিরাপত্তা ইস্যুতে শেরে বাংলার নীতিকে অনুসরণ করা সময়ের দাবি। তাঁর মতো জাতীয়তাবাদী, জনগণকেন্দ্রিক এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ চিন্তাধারা ছাড়া বাংলাদেশের সার্বভৌম উন্নয়ন সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে প্রায়শই অন্য ব্যক্তিত্বদের আলোচনায় শেরে বাংলার অবদান আড়ালে পড়ে যায়, অথচ তাঁর ঐতিহাসিক ভূমিকা ছাড়া আজকের বাংলাদেশ কল্পনাও করা কঠিন।
শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক বাংলার ইতিহাসে কেবল একজন নেতা ছিলেন না—তিনি ছিলেন বাংলার জনতার মুক্তির প্রতীক। তাঁর সংগ্রাম ছিল মাটি ও মানুষের মুক্তির জন্য, তাঁর আদর্শ ছিল সাধারণ মানুষের জীবনে মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য। কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠা, জমিদারি প্রথা বিলুপ্তি, স্বতন্ত্র জাতীয় চেতনা বিকাশ এবং বৈদেশিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে সাহসী উচ্চারণ—সবমিলিয়ে তিনি বাংলার মুক্তির স্থপতি।
আজ যখন আমরা বাংলাদেশের সামনে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে নতুন চ্যালেঞ্জ দেখি, তখন শেরে বাংলার নীতি ও দর্শন থেকে আমরা পথনির্দেশনা নিতে পারি। তাঁর জীবন আমাদের শিক্ষা দেয়—জাতির মাটি ও মানুষের প্রকৃত কল্যাণের পথ কখনও ছলচাতুরি বা আপোষের মাধ্যমে গড়া যায় না; বরং সত্য, সাহস এবং আত্মত্যাগের ওপর দাঁড়িয়েই একটি টেকসই রাষ্ট্র গড়ে ওঠে। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের আদর্শ তাই আজও আমাদের জাতীয় জীবনের অনুপ্রেরণা হয়ে আছে এবং থাকবে।
লেখক : ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ড. একেএম শামছুল ইসলাম, পিএসসি, জি (অব.)
সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
বিডি প্রতিদিন/মুসা