বিগত সরকারের আমলে বিরোধী মত দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়। তাঁদের দিয়ে ঘটানো হয় গুম, খুন ও ভুক্তভোগীদের বছরের পর বছর আটকে রেখে নির্যাতনের মতো ঘটনা। অপহৃত ব্যক্তিকে মুক্তি দেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ মনে করলে তাঁকে হত্যা করা হতো। সেই হত্যায় জড়িত থাকলে মিলত টাকা। অস্বীকার করলে পড়তে হতো বিপদে। তবু বাহিনীর অনেক সদস্য বিপদ জেনেও গোপনে বন্দিদের সাহায্য করার চেষ্টা করতেন। নির্দেশদাতা চলে গেলে বন্দিদের হাতের বাঁধন খুলে দিতেন। গুম কমিশনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সদস্য ও ভুক্তভোগীর দেওয়া সাক্ষ্যে এমন চিত্র সামনে এসেছে। গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেনাবাহিনীর অনেক কর্মকর্তা চাইতেন না তাঁদের সদস্যরা র্যাবে যোগদানের পর খুন-খারাবিতে জড়িয়ে পড়ুক। তবে কেউ এ অপরাধ করলেও তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হতো না। গুম, খুন, নির্যাতনের মতো অপরাধ প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতির অংশ হিসেবে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল, যার প্রমাণ মিলেছে উচ্চপদস্থ এক জেনারেলের সাক্ষাৎকারে। তিনি জানান, সেনাবাহিনী থেকে র্যাবে নিয়োজিত কর্মকর্তারা যাতে খুনের মতো অপরাধে জড়িয়ে না পড়েন সেজন্য তিনি অনেক চেষ্টা করেছেন। এজন্য ব্রিফিং ও ডিব্রিফিংয়ের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। র্যাবে পদায়নের আগে কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলা হতো। আবার দায়িত্ব শেষে ফেরার পর আলাপ করা হতো। স্পষ্টভাবে সতর্ক করা হতো যেন তাঁরা কোনোভাবেই অসহায় বন্দিদের বেআইনিভাবে হত্যা না করেন। এমন এক ডিব্রিফিং সেশনে একজন জুনিয়র কমকর্তাকে তাঁর ঊর্ধ্বতন জিজ্ঞাসা করেন-এ পর্যন্ত তিনি কাউকে হত্যা করেছেন কি না। করলে কজনকে? কিছুক্ষণ ইতস্তত করার পর ওই কর্মকর্তা স্বীকার করেন, তিনি নিজ হাতে দুজনকে হত্যা করেছেন এবং আরও চারটি হত্যাকা প্রত্যক্ষ করেছেন। এ ধরনের অভিযানের পর নিয়মিত অর্থ বিতরণ করা হতো। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানতে চান অভিযানের পর প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে তিনি কী করেছেন। উত্তরে ওই কর্মকর্তা বলেন, তিনি সেই টাকা নিজ গ্রামে মসজিদে দান করে দিয়েছেন। ওই কাজগুলো করে অনুশোচনায় ভুগছিলেন তিনি। গুম ও হত্যায় জড়িত থাকলে চাকরিজীবনেও মিলত পুরস্কার। উদাহরণস্বরূপ গুম কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে-বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার পদে অধিষ্ঠিত এক কর্মকর্তাকে (যাঁর বিরুদ্ধে গুমে জড়িত থাকার প্রমাণ কমিশনের হাতে আছে) তৎকালীন র্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ ‘উদাহরণযোগ্য রেকর্ড’-এর অধিকারী হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। ওই কর্মকর্তার কর্মদক্ষতাকে প্রতিবেদনে ‘খুবই সন্তোষজনক’ হিসেবে উল্লেখ এবং তাঁর নেতৃত্বকে ‘উচ্চমানের’ বলে প্রশংসা করা হয়। একই সঙ্গে তাঁকে পেশাগতভাবে ‘অত্যন্ত দক্ষ’, ‘ভদ্র’ ও ‘সৎস্বভাবের’ কর্মকর্তা হিসেবে বর্ণনা করা হয়। প্রতিবেদনে জোর দিয়ে বলা হয়, ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো নেতিবাচক তথ্য পাওয়া যায়নি।
অন্যদিকে গুম, খুন, রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহির মতো বিষয়ে প্রশ্ন তুললে পেশাগতভাবে ক্ষতির মুখে পড়তে হতো। প্রাণ নিয়েও ভয়ে থাকতেন অনেকে। বিশেষ করে এমন পরিস্থিতিতে তরুণ অফিসাররা চরম অসহায় অনুভব করতেন। বয়স চল্লিশের কোঠায় একজন কর্মকর্তা কমিশনকে জানিয়েছেন, গুম বিষয়ে নিজের মত প্রকাশ করা ও তৎকালীন সরকার নির্ধারিত অবস্থান মেনে না চলার কারণে তাঁকে পরিকল্পিতভাবে সহকর্মীদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। নিরাপত্তা ছাড়পত্র বাতিলকরণের মতো প্রশাসনিক অস্ত্র ব্যবহার করে তাঁর পেশাগত অগ্রগতি নষ্ট করে দেওয়া হয়। এক সৈনিক জানান, র্যাব ইন্টেলিজেন্সের একটি সেফ হাউস থেকে এক বন্দি পালিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু অচিরেই তাঁকে আবার ধরে আনা হয়। ধারণা করা হয়, এর পরপরই বন্দিকে হত্যা করা হয়। সে সময় আশপাশে অবস্থিত একজন তরুণ অফিসার ভয়ে কাঁপছিলেন এবং কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন বন্দি পালিয়ে গেলে প্রতিশোধ নিতে সিনিয়র অফিসার হয়তো তাঁকেই মেরে ফেলতেন বা কঠোর শাস্তি দিতেন। গুমসহ নানান বেআইনি অভিযানে জড়িয়ে পড়া এক কর্মকর্তা তাঁর সহকর্মীকে বলেছিলেন, I didn’t have the courage to refuse at the beginning, and now I’m stuck. (শুরুতে আমার অস্বীকার করার সাহস ছিল না, আর এখন আমি আটকে গেছি)।