অপরিকল্পিত নগর ব্যবস্থাপনা, মেগা প্রকল্পগুলোতে কালক্ষেপণ, যত্রতত্র যাত্রী ওঠানো-নামানো, রিকশার অবাধ বিচরণ, অনিয়ন্ত্রিত গাড়ি পার্কিংসহ বিভিন্ন কারণে ঢাকা এখন বিশ্বের অন্যতম বিশৃঙ্খল ও যানজটের নগরী। বসবাসের প্রায় অযোগ্য এই যানজটের শহরে দিনে ৮২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে নাগরিকদের। এ নিয়ে নগর পরিকল্পনাবিদরা একের পর এক নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। বাজেট পাস করে প্রকল্প বাস্তবায়নও করেছেন। কিন্তু অর্থের অপচয় ছাড়া সেসব প্রকল্পে কাজের কাজ কিছু হয়নি। মাঝেমধ্যে কিছু লোকদেখানো প্রকল্প অল্প সময় স্থায়ী হলেও কোনোটাই শেষ পর্যন্ত টেকেনি। এই মেগা শহরের যানজট নিরসনে দেশীয় প্রযুক্তি নিয়ে এগিয়ে এসেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। তারা এমন একটি সিগন্যাল সিস্টেম উদ্ভাবন করেছেন যা অটোমেটেডের পাশাপাশি ম্যানুয়াল অপশনও রাখা হয়েছে। এই সিগন্যাল বাতি দুভাবে কাজ করবে। এটি সেমি অটোমেটেড সিগন্যাল এইড। একটা বাটনের (বোতাম) মাধ্যমে এ ব্যবস্থাকে ম্যানুয়াল আবার অটোমেটেড (স্বয়ংক্রিয়) করা যাবে। কম যানবাহন থাকলে নির্ধারিত সময়ের জন্য অটোমেটেড মুডে চলবে। বেশি থাকলে ম্যানুয়ালি সময় পরিবর্তন করে নেওয়া যাবে।
জানা গেছে, রাজধানী ঢাকার সড়কের সংযোগগুলোতে মোট ট্রাফিক সিগন্যাল আছে ১১০টি। ডিসেম্বরের শুরুতে প্রাথমিকভাবে চারটি মোড়ে পরীক্ষামূলকভাবে এ পাইলট প্রকল্প চালু করার কথা ছিল। কিন্তু এখনো তা চালু করা সম্ভব হয়নি। তবে তিনটি মোড়ে (হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, কারওয়ান বাজার ও ফার্মগেট) এ প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। সেখানে এখন টেস্ট চলছে। বাংলামোটর মোড়ের কাজও প্রায় শেষের দিকে। এ প্রকল্প চালু হলে অকাজে ব্যয় হওয়া সময় ও টাকা সাশ্রয় হবে। দেশীয় প্রযুক্তির এই সিগন্যাল সিস্টেম ও বাতি পর্যায়ক্রমে সব গুরুত্বপূর্ণ স্পটে লাগানো হবে।
পাইলট প্রকল্পের আওতায় ২২টি স্পটে এই সিগন্যাল বাতি লাগানোর পরিকল্পনা রয়েছে। দেশীয় প্রযুক্তিতে অত্যন্ত কম খরচে বাতিগুলো বসানো হবে। প্রাথমিকভাবে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, বাংলামোটর, কারওয়ান বাজার ও ফার্মগেট মোড়ে এটি স্থাপন করা হচ্ছে। পরবর্তীতে ক্রমান্বয়ে শিক্ষা ভবন মোড়, কদম ফোয়ারা, মৎস্য ভবন মোড়, শাহবাগ মোড়, কাকরাইল মসজিদ মোড় হয়ে মিন্টো রোডের মোড়ে বসবে। পরে বিজয় সরণি, জাহাঙ্গীর গেট, মহাখালী, খিলক্ষেত, বিমানবন্দর হয়ে আবদুল্লাহপুর মোড় পর্যন্ত ২২টি গুরুত্বপূর্ণ স্পটে দেশীয় প্রযুক্তির ট্রাফিক সিগন্যাল বসানো হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা শহরে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার জন্য বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে ‘ক্লিন এয়ার অ্যান্ড সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট’ (কেস) প্রকল্পের আওতায় ১১২ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৯টি মোড়ে বসানো হয় সিগন্যাল বাতি। ২০১৬ সালে ঢাকার চারটি মোড়ে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিস্টেম বসানোর আরেকটি উদ্যোগ নেয় ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)। শুরুতে ব্যয় ছিল ৩৭ কোটি টাকা, পরে বেড়ে হয় ৫২ কোটি টাকা। কিন্তু কোনো কিছুই কাজে আসেনি। ফলে নগরীর সব জায়গায় বর্তমানে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা ম্যানুয়ালি যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে আগে যেসব পদ্ধতি ব্যবহার হয়েছে সেগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করার ফলে খরচ ছিল অনেক বেশি। সেগুলো চালানোর জন্য লোকবলের অভাব, উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় সব বাজেট ভেস্তে গেছে। আবার এগুলো নষ্ট হলে পুনরায় আমদানি করতে হতো। সেটাও অনেক সময়সাপেক্ষ বিষয়। অনেক সময় দেখা যায় এক বছর সময় লাগিয়ে নির্দিষ্ট যন্ত্রাংশ আমদানি করা হলেও পূর্বের সচল যন্ত্রাংশগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে পুরো সিস্টেমই অচল হয়ে পড়ে। তবে বর্তমান ব্যবস্থাটি দেশীয় প্রযুক্তিতে বুয়েটেই তৈরি করা হবে। ফলে এর রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের কাজও এখান থেকে দেখা হবে। যখন যেটা নষ্ট বা অকার্যকর হবে তখনই সেটা পরিবর্তন বা মেরামত করা সম্ভব হবে।
বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, দেশীয় প্রযুক্তিতে ট্রাফিক সিগন্যাল বাস্তবায়নের পাইলট প্রকল্প হিসেবে আরও এক মাস আগে চারটি মোড়ে পরীক্ষামূলকভাবে চালু হওয়ার কথা ছিল। তিনটি মোড়ে চালু হয়েছে। সেটা টেস্ট ফেজে আছে। আরেকটি মোড়ে এ প্রযুক্তি স্থাপনের কাজ শেষের দিকে। প্রাথমিকভাবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে দুটি স্পটে এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে দুটি স্পটে ট্রাফিক সিগন্যাল স্থাপন করা হয়েছে। আমরা এখনো অপারেশন মুডে যাইনি। বাংলামোটর মোড়ে কাজ শেষ হলেই চারটি মোড়ে অপারেশনে যেতে পারব। পাইলট প্রকল্প হিসেবে মৎস্য ভবন থেকে আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত ২২টি গুরুতপূর্ণ স্পটে এটি স্থাপন করা হবে।
তিনি আরও বলেন, ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) সমন্বয়ে এই প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করছে বুয়েট ও সিটি করপোরেশন। বুয়েট ট্রাফিক সিগন্যালের ডিজাইন ও প্রযুক্তি দিয়ে সহযোগিতা করছে। আর সিটি করপোরেশন ভৌত অবকাঠামে দিয়ে সহযোগিতা করছে। যত্রতত্র যানবাহন ও পথচারী পারাপার বন্ধের জন্য আমরা অনুরোধ করেছি। বলেছি যত্রতত্র পথচারী পারাপার বন্ধে এসব মোড়ে জেব্রা ক্রসিংয়ের উভয় পাশে ৫০ মিটার করে বেড়া নির্মাণ করে দিতে। ফলে এটি একদিকে যেমন যানবাহন চলাচল নিরাপদ করবে অন্যদিকে পথচারীদের নির্র্বিঘ্নে ও নিরাপদে রাস্তা পারাপারের জন্যও কার্যকর হবে। দেশীয় প্রযুক্তির ট্রাফিক সিগন্যাল প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় অনেক পরিবর্তন আসবে।