কেবল বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্বকে বদলে দেওয়ার অভিপ্রায় শান্তিতে নোবেলজয়ী প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের। আর বদলে দেওয়ার মাধ্যমটা হচ্ছে বিজনেস, সোশ্যাল বিজনেস। দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, সোশ্যাল বিজনেস শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো বিশ্বকে বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। শুক্রবার সাভারের জিরাবো সামাজিক কনভেনশন সেন্টারে দুই দিনের ‘সোশ্যাল বিজনেস ডে’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এ দৃঢ়তার কথা জানান।
সম্মেলনে শরিক হন বিশ্বের ৩৮টি দেশের এক হাজার ৪০০ জনেরও বেশি প্রতিনিধি।
যুদ্ধ-সংঘাতে মানুষ হতাশ হয়ে যাচ্ছে মন্তব্য করে ড. ইউনূস বলেছেন, এতে বিশ্ব এগিয়ে যাওয়ার বদলে পিছিয়ে পড়ছে। তার পরও নতুন বিশ্ব গড়ার স্বপ্ন দেখার আহবান জানিয়ে পৃথিবীকে বদলে দিতে সব জাতিকে ভূমিকা রাখার আহবান জানান তিনি। সোশ্যাল বিজনেসকে স্বাবলম্বী হওয়ার একটি বড় উপায় বলে আবারও উল্লেখ করেছেন তিনি।
দিবসটি পালনে বিগত সরকারের আপত্তি ছিল। ৫ আগস্টের পর এবারই প্রথম দিবসটি পালন করতে পারছে সবাই। স্বাবলম্বী, সক্ষমতা, সম্প্রীতির জন্য এটি অবশ্যই আশা জাগানিয়া ব্যাপার। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার সিডনিভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড পিস-আইইপি দিয়েছে হতাশার তথ্য।
তাদের প্রকাশিত এ বছরের গ্লোবাল পিস ইনডেক্স-জিপিআই, শান্তিসূচকে বাংলাদেশের অবস্থান নিম্নমুখী। এ সূচকে গতবারের চেয়ে ৩৩ ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান বৈশ্বিক শান্তি সূচকে ২.৩১৮ স্কোর নিয়ে ১২৩তম। গত বছর ১৬৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ছিল ৯৩তম স্থানে। কী দাঁড়াল অবস্থাটা? শান্তিতে নোবেলজয়ী তথা শান্তিদূতের দেশেই শান্তি সূচকের অবনতি ড. ইউনূসের জন্য বেমানান, অসম্মানের।
চ্যালেঞ্জেরও। চাইলে তিনি চ্যালেঞ্জ নিতে পারেন সূচককে অসত্য প্রমাণের। আর চ্যালেঞ্জ জেতার একমাত্র পথ দেশকে শান্তির সিঁড়িতে নেওয়ার পদক্ষেপ গ্রহণ। দেশের মানুষ মন-প্রাণ সঁপে তাঁকে সেই ম্যান্ডেট দিয়েই রেখেছে। জরিপটিতে কিন্তু স্বস্তি বা যুক্তির একটু জায়গা রয়েছে। সেটা মেলে বিশ্বের সুপার পাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনা করলে। ২.৪৪৩ স্কোর নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র রয়েছে ১২৮তম স্থানে। নিজের তৃপ্তি নিজে খুঁজলে বলা যায়, শান্তিসূচকে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ।
বৈশ্বিক শান্তিসূচক নির্ণয়ে এবার আমলে নেওয়া হয়েছে ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তাকে। এতে বৈশ্বিক শান্তির গড় স্তর ০.৩৬ শতাংশ কমেছে। সূচক বলছে, শান্তিতে বরাবরের মতো শীর্ষে ইউরোপীয় দেশগুলো। টপ টেনের নাম্বার ওয়ানে আইসল্যান্ড। দ্বিতীয় আয়ারল্যান্ড, তৃতীয় নিউজিল্যান্ড, চতুর্থ অস্ট্রিয়া, পঞ্চম সুইজারল্যান্ড। এরপর যথাক্রমে সিঙ্গাপুর, পর্তুগাল, ডেনমার্ক, স্লোভেনিয়া এবং দশম ফিনল্যান্ড। সবচেয়ে কম শান্তিপূর্ণ পাঁচ দেশ—সুদান, কঙ্গো, দক্ষিণ সুদান, ইয়েমেন ও আফগানিস্তান। অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটির মূল্যায়ন না করলেও কারো জানা-বোঝার বাকি থাকছে না, বিশ্বে দিন দিন শান্তি কমছে। দুনিয়ার নানা প্রান্তে নানা ধরনের অশান্তির বিস্তার ঘটছে। গত ১৭ বছরে গড় দেশভিত্তিক শান্তিসূচক ৫.৪ শতাংশ কমে গেছে, যা ২০০৮ সাল থেকে বৈশ্বিক শান্তির ধারাবাহিক পতনের ইঙ্গিত দেয়।
আইইপি বলছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে শান্তির এমন অবনতি ঘটেনি। এর মাঝেও আশাব্যঞ্জক দিক হচ্ছে, চলতি বছর ৭৪টি দেশের শান্তিসূচকে উন্নতির লক্ষণ দেখা গেছে। আইসল্যান্ড টানা ২০০৮ সাল থেকে বিশ্বের সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ দেশের মর্যাদা ধরে রেখেছে। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা অঞ্চল টানা দশম বছরের মতো সবচেয়ে কম শান্তিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তা হওয়ারই কথা। কিন্তু আমাদের কেন এত অবনতি? কেন শান্তিসূচকে সবচেয়ে বেশি অবনতি বাংলাদেশের? এমন কী ঘটেছে যে ৩৩ ধাপ নিচে নেমে আসবে? যা এই সূচকের শুরু থেকে সর্বনিম্ন র্যাংকিং। এসব প্রশ্নের কিছু জবাব অবশ্যই আছে। গেল কয়েকটি বছর নানা যন্ত্রণা পোহাতে হয়েছে। গত বছর তো কেটেছে চরম অশান্তিতে। অশান্তির এ ধারাপাতের মাঝেই শান্তির নোবেল লরিয়েট ড. ইউনূসের রাষ্ট্রক্ষমতায় অভিষেক। নোবেল ছাড়াও আরো নানা গুণে-বিশেষণে বিশ্বমঞ্চে অনন্য উচ্চতা তাঁর। ক্ষমতার এক বছর হবে হবে অবস্থা। এ সময়ের স্কেলে শান্তির নমুনা বা আশার পারদ ছিল ওপরে।
তবে কি ড. ইউনূসের ম্যাটিকুলাসে গোলমাল ঘটেছে? নাকি সেখানে নতুন কোনো ক্যালকুলাস ভর করেছে? ম্যাটিকুলাস তাঁর খুব পছন্দের শব্দ। কোনো রাখঢাক না রেখে সরল স্বীকারোক্তির মতো বলেছেন, জুলাই-আগস্টে শেখ হাসিনার সরকারবিরোধী আন্দোলনটি ছিল ম্যাটিকুলাস। মানে সুপরিকল্পিত। যে পরিকল্পনায় ভুল থাকে না। আবার ড. ইউনূসের টোটাল লাইফ স্টোরিও বেশ ম্যাটিকুলাস-গোছানো। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ম্যাজিক্যালও। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনায় তাঁর ক্যালকুলেশনে ম্যাটিকুলাসের ছাপ শুরু থেকেই কম। ক্রমেই ঘাটতি। ম্যাজিক ফলছে না, ম্যাটিকুলাস পরিকল্পনার দেখা মিলছে না দেশ পরিচালনায়। বাংলা অভিধানে ম্যাটিকুলাসের অর্থ-অতিরিক্ত যত্নবান, খুঁটিনাটি বিষয়ে মনোযোগী, নিখুঁতভাবে ইত্যাদি।
ম্যাটিকুলাস আর ক্যালকুলাস শব্দ দুটি বাংলা ভাষায় প্রায় কাছাকাছি অর্থে ব্যবহার হলেও আসলে দুটির মেজাজ যে ভিন্ন, তা দেখা যাচ্ছে নোবেল লরিয়েট বিশ্বজোড়া কীর্তিমান-খ্যাতিমান প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ক্ষেত্রে। ক্ষমতার প্রতি তাঁর কোনো মোহ নেই—এ কথা দেশে-বিদেশে বারবারই বলে আসছেন তিনি। এবার যুক্তরাজ্যে গিয়ে আরো যোগ করেছেন, ‘পরবর্তী সরকারের অংশ হওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই তাঁর। জোর দিয়ে বললেন, তাঁর সরকারের কাজ হলো—সফল ও শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা, যা নির্বাচন দ্বারা সম্পন্ন হবে। তাঁর কথায় শান্তির কথা বেশি বেশি আসে বরাবরই। আসে উন্নয়ন-উন্নতি, স্বাবলম্বী হওয়ার কথাও।
প্রধান উপদেষ্টা ব্যক্তি হিসেবে নির্মোহ বলে প্রচারিত। বিপরীতেও কথা আছে। সেখানে চলে আসে কর মাফ, মামলা বাদ, বিশ্ববিদ্যালয়, ট্রাভেল এজেন্সির লাইসেন্স, প্রামীণ ব্যাংকে সরকারের মালিকানা কমানোর কথা। এসব কাজের কারণে তাঁর নিজের স্বার্থ আর জাতীয় স্বার্থ একাকার হয়ে যাওয়ার কথা উঠেছে। দীর্ঘদিন ধরে তিনি নিজেকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে একজন ‘জাতির শুভাকাঙ্ক্ষী’ হিসেবে উপস্থাপিত হয়ে আসছিলেন। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট, ব্যক্তিগত সুবিধা এবং জাতীয় স্বার্থকে তিনি একসঙ্গে মেলাতে চেয়েছেন, কখনো কখনো জাতীয় স্বার্থকে নিজের সুবিধার পেছনে রেখে। ব্যক্তিগত কিছু সুবিধার বাস্তবায়ন তিনি ঘটিয়েছেন। ট্যাক্স মামলায় অব্যাহতি ও কর মওকুফ একদম প্রকাশ্যে। প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই তাঁর বিরুদ্ধে থাকা আয়কর ফাঁকিসংক্রান্ত মামলায় অব্যাহতি দেওয়া হয়। বহু কোটি টাকার ট্যাক্স বকেয়া থাকা সত্ত্বেও একটি নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে তাঁর ওপর থাকা কর মওকুফ করে দেওয়া হয়।
নোবেল পুরস্কারের কর মওকুফ আইন প্রণয়নও হয়েছে। যেখানে বলা হয়, আন্তর্জাতিক সম্মাননাপ্রাপ্ত ব্যক্তি করমুক্ত হবেন। এ ছাড়া গ্রামীণ ইউনিভার্সিটির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বহুদিন ধরে আটকে থাকা গ্রামীণ ইউনিভার্সিটির পূর্ণ অনুমোদন পাওয়া গেছে তাঁর দায়িত্ব গ্রহণের অল্প সময়ের মধ্যেই। এমনকি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পূর্ব আপত্তি থাকা সত্ত্বেও বিষয়টি দ্রুত নিষ্পত্তি করা হয়। গ্রামীণ ব্যাংকের সরকারি নিয়ন্ত্রণ হ্রাস ও শেয়ার সংখ্যা কমানো হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ ছিল একটি বিতর্কিত ইস্যু। তাঁর নেতৃত্বে সরকার গ্রামীণ ব্যাংকে সরকারের শেয়ার কমিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেয়, যাতে তাঁর প্রতিষ্ঠানের ওপর রাষ্ট্রীয় নজরদারি দুর্বল হয়। এতে ব্যাংকটির স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। গ্রামীণ ম্যানপাওয়ারের লাইসেন্স নবায়ন ও সম্প্রসারণও হয়েছে।
ড. ইউনূস সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর জনশক্তি রপ্তানিতে কিছু অগ্রগতি হয়েছে। বিশেষত মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের নতুন বাজারে শ্রমিক পাঠানোর বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, এই উন্নয়নের মূল উদ্দেশ্য কী শুধুই জাতীয় উন্নয়ন, নাকি এর পেছনে নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের লাভবান হওয়ার কৌশলও কাজ করেছে? ড. ইউনূসের চব্বিশের সাহসী ম্যাটিকুলাস পদক্ষেপের কয়েক বাক্যের প্রশংসা হতে না হতেই প্রশ্ন ছোড়া হচ্ছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে দৃশ্যমান কী ভূমিকা ছিল তাঁর? জানতে চাওয়া হচ্ছে, দক্ষিণপন্থীদের প্রতি তাঁর দুর্বলতার হেতু কোথায়? জবাবে জানাতে হচ্ছে, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য টেনিসে রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত ছিলেন। সেখানে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের জন্য সমর্থন জোগাতে তিনি বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টার পরিচালনা করতেন। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশভিলের তাঁর নিজ বাড়ি থেকে প্রকাশ করতেন ‘বাংলাদেশ নিউজলেটার’।
ড. ইউনূস মোটেই বাংলাদেশবিরোধী বা পাকিস্তানপন্থী ছিলেন না। কিন্তু অবস্থা কোথায় গড়ালে প্রশ্ন জন্ম নেয়? নতুন করে জানাতে হয় পুরনো তথ্য? মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁর ঘটনাবহুল দিনের কথা তাঁর লেখা ‘গ্রামীণ ব্যাংক ও আমার জীবন’ আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থেও রয়েছে, যা মোটেই অসত্য বা বানোয়াট নয়। কিন্তু ম্যাটিকুলাসে ক্যালকুলাস ভর করলে প্রচার-প্রসারেও তা রক্ষা করা যায় না। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের সাফল্য সরকার পরিচালনায়ও থাকলে এত প্রশ্ন আসত না। প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার গত ১০ মাসে তাঁর ডজনখানেক বিদেশ সফরও প্রশ্নমুক্ত নয়। এই সফরগুলোর মধ্যে শুধু চীন সফরই ছিল দ্বিপক্ষীয় সফর। বাকিগুলোর বেশ কয়েকটিই বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে অতি উৎসাহে আয়োজন করা। এত বিদেশ সফর এই নোবেলজয়ীর জন্য বড় ঘটনা না হলেও প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের জন্য ঘটনা। প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার আগে তিনি যখন নিজের খরচে বা আয়োজকদের খরচে বিদেশ ভ্রমণ করতেন, নানা পুরস্কার গ্রহণ করতেন, সেগুলো ছিল প্রশংসিত। এখন তা নয়। এ বাস্তবতা না বুঝলে, না মানলে ম্যাটিকুলাস নিরর্থক হয়ে যায়। এ দেশের মানুষ কাউকে মাথায় তুলতে সময় নেয় না, ছুড়ে ফেলতেও সময় নেয় না—এটি আরেক ক্যালকুলাস। তাঁর কাছ থেকে দেশপ্রেম ও ত্যাগের জনপ্রত্যাশার সঙ্গে না মেলার কারণেই এত কথা ও প্রশ্নবাণ, যা কারণে-অকারণে, যৌক্তিক-অযৌক্তিকে ভজঘট বাধিয়ে দিচ্ছে ড. ইউনূসের ম্যাটিকুলাস অভিযাত্রায়।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল