২০১৮ সালে ‘রাতের ভোটে’ বিজয়ী হওয়ার পর আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে। আওয়ামী লীগের এ মন্ত্রিসভায় সবচেয়ে বড় চমক ছিলেন তাজুল ইসলাম। রাজনীতিতে একেবারে অগুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যবসায়ীকে সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়াটা ছিল বিস্ময়কর। এ সিদ্ধান্তে গোটা জাতি হয়েছিল হতবাক। কীভাবে এটা সম্ভব ছিল? এটাই হলো আওয়ামী লীগ সরকারের সীমাহীন দুর্নীতির একটি উদাহরণ। টাকার বিনিময়ে গত সাড়ে ১৫ বছরে সব হয়েছে।
তাজুল ইসলাম তাঁর কর্মজীবন শুরু করেছিলেন চোরাচালানের মাধ্যমে। কুমিল্লায় বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত দিয়ে অবৈধ মাল আনা-নেওয়ার ব্যবসা করতেন তাজুল। এ ব্যবসা করতে করতে একসময় তিনি সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট হন। চোরাচালান আর সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসার মাধ্যমে একসময় ফুলে ফেঁপে ওঠেন তাজুল ইসলাম। এ সময় অবৈধ অর্থ বাঁচানোর জন্য এবং অবৈধ সম্পদ বৈধ করতে রাজনীতিতে যোগ দেন। আস্তে আস্তে রাজনীতিকেই বানিয়ে ফেলেন ‘ব্যবসা’। প্রথমে টাকা দিয়ে আওয়ামী লীগের কমিটিতে ঢোকেন তাজুল ইসলাম। এরপর টাকা দিয়ে এমপি হন। এমপি হওয়ার পর রাজনীতিই হয়ে ওঠে তাঁর প্রধান ব্যবসা। ঘনিষ্ঠদের বলতেন, ‘রাজনীতির চেয়ে লাভজনক আর কোনো ব্যবসা নেই।’ ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর মন্ত্রী হওয়ার জন্য ‘বিনিয়োগ’ করেন ১০০ কোটি টাকা। বাগিয়ে নেন সরকারের সবচেয়ে লোভনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ ‘স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়’। বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় মন্ত্রণালয় এটি। এখানে বাজেট বরাদ্দ সবচেয়ে বেশি। সারা দেশে এ মন্ত্রণালয়ের অধীনে নানান কাজ হয়, হয় টেন্ডার, উন্নয়ন প্রকল্প। ঐতিহ্যগতভাবে এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান দলের সাধারণ সম্পাদক। ২০০৯ সাল পর্যন্ত এটাই হয়ে এসেছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা এটি পাল্টে দেন। নিজের বেয়াইকে এ লোভনীয় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন, যেন তিনি ইচ্ছামতো লুটপাট করতে পারেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় নিলামে বিক্রি হয়। মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণের দিনই তাজুল ইসলাম কোনোরকম রাখঢাক না রেখেই ঘোষণা করেন, ‘আমি টাকা দিয়ে মন্ত্রী হয়েছি। লাভসহ টাকা তুলতে হবে।’ ঘনিষ্ঠদের তিনি সব সময় বলতেন, ‘১০০ কোটি টাকা দিয়ে মন্ত্রী হয়েছি।’ মন্ত্রণালয়ে কোনো ফাইল গেলেই তিনি কমিশন দাবি করতেন। মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বলতেন, ‘জানেন এ চেয়ারটার দাম কত?’ উত্তরের অপেক্ষা না করে নিজেই বলতেন, ‘১০০ কোটি টাকা দিয়ে এ চেয়ার কিনেছি। কমিশন না দিলে টাকা উঠবে কীভাবে?’ ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত তাজুল নির্বিচার লুণ্ঠন করেছেন এ মন্ত্রণালয়। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় হয়ে উঠেছিল লুটের মন্ত্রণালয়। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা তাঁকে বলতেন ‘শতকোটি টাকার মন্ত্রী’।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হলফনামায় তাজুল যে সম্পদ থাকার ঘোষণা দেন, তাতে দেখা যায় ২০০৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত তাঁর সম্পদ বেড়েছ ২৪২ গুণ। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামা অনুযায়ী ১০ বছর আগে তাজুল ইসলামের মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ১৬ কোটি টাকার কিছু বেশি। বর্তমানে তা ১১৮ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু বাস্তবে তাঁর অবৈধ সম্পদের পরিমাণ বহুগুণ বেশি। এলজিআরডি মন্ত্রী থাকাকালে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার বিভাগ, জেলা পরিষদ, উপজেলা ও পৌরসভায় উন্নয়নের নামে দেওয়া বরাদ্দ থেকে কমিশন বাণিজ্যের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তাজুল ইসলাম।
জেলা, উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের উন্নয়নকাজে যে বরাদ্দ দেওয়া হতো, সেসব বরাদ্দ থেকে নির্দিষ্ট অঙ্কের কমিশন দিতে হতো তাজুল ইসলামকে। তাঁর ব্যক্তিগত আদায়কারী ছিলেন তাঁর ভাতিজা শাহাদাৎ ও এপিএস জাহিদ। কমিশন বাণিজ্যে তাঁর শ্যালক লাকসাম উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মহব্বত আলী, ভাতিজা মনোহরগঞ্জ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আমিরুল ইসলাম ও তাঁর উন্নয়ন সমন্বয়ক কামাল হোসেন। কমিশন বাণিজ্যের ফলে তাঁরাও এখন একেকজন শতকোটি টাকার মালিক।
মো. তাজুল ইসলাম ব্যবসায়ী থেকে রাজনীতিতে আসার কয়েক মাসের মধ্যেই ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো কুমিল্লা-৯ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালের পর যত জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে, প্রতিটিতেই এ আসনে নৌকার প্রার্থী ছিলেন তিনি। ২০০১ সালের নির্বাচনে পরাজিত হলেও ২০০৮ সাল থেকে টানা চার মেয়াদে কুমিল্লা-৯ আসনের এমপি নির্বাচিত হয়েছেন তাজুল। লাকসামের আওয়ামী লীগ নেতা আইনজীবী ইউনুস ভূঁইয়ার হাত ধরে রাজনীতিতে আসা তাজুল প্রথমবার এমপি নির্বাচিত হওয়ার পরই নিজের ভোল পাল্টাতে শুরু করেন।
দশম, একাদশ ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে তাজুল ইসলামের দাখিল করা হলফনামা বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, সাবেক এই মন্ত্রী বছরে আয় করেছেন ৪ কোটি ১৭ লাখ টাকা। মন্ত্রিত্ব পাওয়ার পর তাজুল লুটপাট আর অবৈধ সম্পদ অর্জনে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। দেশে ও বিদেশে বিপুল সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। ১০ বছর আগে ২০১৪ সালের নির্বাচনে হলফনামায় দেওয়া তথ্যে তাঁর মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ১৬ কোটি টাকার কিছু বেশি। আর গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে দেওয়া হলফনামা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তাজুলের সে সম্পদ ১১৮ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। আর মন্ত্রী হওয়ার আগে ২০১৮ সালে তাঁর মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ৪৭ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। চার বছরের ব্যবধানে সে সম্পদ দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। তবে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বাস্তবে তাঁর সম্পদের পরিমাণ আরও অনেক বেশি। বিদেশেও রয়েছে তাঁর হাজার কোটি টাকার সম্পদ।
মন্ত্রণালয় চালাতেন তাজুলের সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) জাহিদ হোসেন ও ভাতিজা আমিরুল ইসলাম। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বদলি, টেন্ডার বাণিজ্য, নিয়োগে ঘুষ বাণিজ্য, স্থানীয় সরকার পর্যায়ে বিভিন্ন স্থানে অর্থ বরাদ্দ, স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্ত কিংবা প্রত্যাহার সবকিছু হতো তাঁদের ইশারায়। বড় বড় আমলাও ছিলেন তাঁদের ভয়ে তটস্থ। মন্ত্রী নিয়মিত সচিবালয়ে না গেলেও তাঁরা অফিস করতেন নিয়মিত। মন্ত্রী তাজুল ইসলাম হলেও মন্ত্রণালয় পরিচালনা করতেন এ দুই ‘ছায়ামন্ত্রী’।
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পট পরিবর্তন হওয়ার পর মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা মুখ খুলতে শুরু করেছেন। তাঁরা বলছেন, এপিএস জাহিদ ও ভাতিজা ছায়ামন্ত্রী হিসেবে নানান অনিয়ম-দুর্নীতি করেছেন। সবকিছু ছিল তাঁদের কবজায়। ভাতিজা ও এপিএসের সঙ্গে দেখা না করে মন্ত্রীর কাছে গেলে কোনো কাজ হতো না। মন্ত্রী নিজেই জিজ্ঞেস করতেন তাঁদের সঙ্গে দেখা হয়েছে কি না। এ সুযোগে তাঁরা এখন কোটি কোটি টাকার মালিক।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর (ডিপিএইচই), ওয়াসা, সিটি করপোরেশন, জেলা ও উপজেলা পরিষদ, পৌরসভার প্রকল্প গ্রহণ, টেন্ডার ও ঠিকাদার নিয়োগ করতেন ভাতিজা ও এপিএস। একই সঙ্গে এসব সংস্থার কর্মকর্তাদের বদলি, থোক বরাদ্দ, বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণসহ সব কার্যক্রমই মূলত তাঁদের দুজনের নিয়ন্ত্রণে হতো। এসব প্রকৌশলীর বদলি হতে ৩০ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত নিতেন তাঁরা। আর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী বদলি ও প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা রেট ধার্য ছিল। ঢাকার বনশ্রীতে রয়েছে তাঁর হাউজিং ব্যবসা। এসব করে রাতারাতি শতকোটি টাকার মালিক বনে যান তাঁরা।
কুমিল্লা এলজিইডি অফিসের টেন্ডারবাজির নিয়ন্ত্রণ, ঠিকাদারি, মন্ত্রীর কমিশন বাণিজ্য এবং অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকেন। মাস্টার এন্টারপ্রাইজ নামে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে লাকসাম-মনোহরগঞ্জের এলজিইডির বেশির ভাগ ঠিকাদারি বাগিয়ে নিতেন তিনি। কোটি কোটি টাকার কাজ কমিশন নিয়ে সাবকন্ট্রাক্টে বিক্রি করে দিতেন পিএস কামাল। মাত্রাতিরিক্ত অনিয়ম-দুর্নীতির ফলে দুদক কামালের বিরুদ্ধে মামলাও করে। ৯ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০২৩ সালের ২৩ নভেম্বর দুদক কুমিল্লার সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক পাপন কুমার সাহা বাদী হয়ে মামলাটি করেন। দুদকের অনুসন্ধানে তাঁর নিজ নামে স্থাবর ও অস্থাবর মিলিয়ে ১৫ কোটি ১৭ লাখ ৮৯ হাজার ২৫৫ টাকার সম্পদের তথ্য পাওয়া যায়। দুদক সূত্র জানান, তাঁর পারিবারিক ব্যয়, পরিশোধিত কর, অপরিশোধিত দায়সহ ১৭ কোটি ১৩ লাখ ৯৯ হাজার ২৬ টাকার নিট সম্পদ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৮ কোটি ২০ লাখ ২১ হাজার ৮০ টাকার সম্পদের বৈধ উৎস পাওয়া গেছে। আর ৮ কোটি ৯৩ লাখ ৭৭ হাজার ৯৪৬ টাকার সম্পদের কোনো বৈধ উৎস পাওয়া যায়নি।
কামালের বিপুল সম্পদের সিকিভাগও দুদকের তদন্তে আসেনি। তাঁর কুমিল্লার হাউজিং এস্টেটে একাধিক বাড়ি, কান্দিরপাড় এলাকায় বিগ বাজার সুপার মার্কেট, একই এলাকায় অনেক ফ্ল্যাট, ঢাকায় ফ্ল্যাট ও প্লট এবং কৃষি ও অকৃষি জমির তথ্য বের করতে পারেনি দুদক। স্থানীয়রা জানান, শুধু কুমিল্লা শহরেই কামালের ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। তাঁর মোট সম্পদের পরিমাণ ৬০০ কোটি টাকার বেশি। তাঁরা তাঁর এসব অবৈধ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার দাবি জানিয়েছেন। মনোহরগঞ্জ উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান জাকির হোসেন বলেন, ‘কামাল কৃষকের ছেলে। ঠিকমতো খেতেও পারতেন না। তিনি এখন কয়েক শ কোটি টাকার মালিক! দুদক তাঁর বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করলেও সম্পদের সিকিভাগও বের করতে পারেনি। তাঁর দৃশ্যমান কয়েক শ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে।’ মো. তাজুল ইসলাম এলজিআরডি মন্ত্রী থাকাকালে সাড়ে পাঁচ বছর শুধু কুমিল্লায় ডিপিএইচইর হাজার কোটি টাকার কাজ হয়েছে। প্রতিটি কাজের ঠিকাদার নিয়োগ দিতেন কামাল। প্রতিটি কাজ থেকে ১০ শতাংশ কমিশন নিতেন। আর এর সহযোগী ছিলেন ডিপিএইচই কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ নাসরুল্লাহ। তিনিও নামে-বেনামে প্লট, ফ্ল্যাটসহ কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যান। অভিযোগ রয়েছে, ২০২২ সালের ২৬ জুলাই কার্যাদেশ দেওয়া কাজ মাত্র চার দিনে অর্থাৎ ৩০ জুলাই শেষ হয়ে যায়। আড়াই কোটি টাকার এ কাজ সম্পন্ন ও চূড়ান্ত বিল প্রদানের মতো হরিলুট করেছেন এই কর্মকর্তা ও মন্ত্রীর সহচর কামাল। এভাবেই রাজনীতিকে সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা বানিয়েছিলেন তাজুল ইসলাম।