দাউদ হায়দার, নামটা শুনলে এখনও কেঁপে ওঠে ভারতের বাণিজ্য শহর। দাউদ হায়দার যতোটা বাস্তব, তার চেয়েও বেশি মিথ। কারো কাছে এখনও তিনি রোমাঞ্চকর চরিত্র। ভারত সরকারের অন্যতম শত্রু। তিনি কোথায় আছেন, কি করছেন, সে নিয়েও আছে বিস্তর ধোঁয়াশা। সেই সাথে দাউদের বাকি সহযোগীরাও ছিলেন আলোচনায়, পুলিশ কিংবা ক্যামেররা নজরে।
সত্তর-আশির দশকে মুম্বাইয়ে সিনেমার টিকিটের কালোবাজারি করা দিয়ে অপরাধজগতে হাতেখড়ি রাজেন্দ্র সদাশিবের। তবে টিকিটের সামান্য কালোবাজারির মধ্যে নিজেকে আটকে রাখতে চাননি। ধীরে ধীরে মুম্বাইয়ের অপরাধজগতের ডন হয়ে ওঠেন তিনি। মুম্বাইয়ের ত্রাস দাউদ ইব্রাহিমের ডান হাত হিসাবেও তার নাম উঠে আসতে শুরু করে।
মুম্বাই পুলিশের খাতায় নাম ওঠার পর ‘খ্যাতি’ বাড়তে বাড়তে ইন্টারপোলের খাতায় নাম উঠে যায় তার। মুম্বাইয়ের অপরাধজগতের একাংশ শাসন করা সেই ডন ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ হয়ে ছিলেন টানা দু’দশক! আসলে, রাজেন্দ্র সদাশিব নিকালজে মুম্বাইয়ের চেম্বুরের সিনেমাহলগুলিতে শুধুই ‘টিকিট ব্ল্যাকার’ হিসাবে থাকতে চাননি।
রাজেন্দ্র নাম বললে তাঁর পরিচয় নিয়ে কেউ মাথা ঘামাতে না-ই পারেন। ছোটা রাজনই হলেন রাজেন্দ্র সদাশিব নিকালজি। টিকিটের কালোবাজারি করার সময় থেকেই ডাকাবুকো ছিলেন রাজেন্দ্র। শোনা যায়, পুলিশ ধরতে এলে লাঠি কেড়ে তাদেরই লাঠিপেটা করতেন রাজেন্দ্র।
অপরাধজগতে ছোটা রাজনের সফর বেশ আকর্ষণীয়। টিকিটের কালোবাজারি করতে করতে ‘ডি-কোম্পানি’র স্তম্ভ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। পরবর্তী সময়ে দাউদের ‘এক নম্বর শত্রু’ও হয়ে যান। ১৯৮০ সালে ‘বড়া রাজন’ গোষ্ঠীতে যোগ দেন রাজেন্দ্র। তখনও ‘ছোটা রাজন’ নামটি তার আসল নামটিকে আড়াল করেনি। বুঝেছিলেন, তাড়াতাড়ি ‘বড়’ হয়ে ওঠা যায় একটি মাত্র জগতে পা রাখলে ‘আন্ডার ওয়ার্ল্ড’। ধুরন্ধর রাজেন্দ্র সদাশিব সেই দুনিয়াতেই নিজেকে সঁপে দিয়েছিল।
২০১৫ সালে ইন্দোনেশিয়ায় গ্রেফতার হয়েছিলেন ডন দাউদ ইব্রাহিমের সাবেক সঙ্গী ছোটা রাজন। প্রত্যর্পণের মাধ্যমে তাকে হাতে পেয়েছিল ভারত। ২০১৫ সালের নভেম্বরে তাকে দেশে নিয়ে আসা হয়। একদা দোর্দণ্ডপ্রতাপ সেই ডনের ঠিকানা তিহাড় জেলের কুঠুরি। দাউদের হাত থেকে বাঁচার জন্য থাইল্যান্ডের ব্যাঙ্কক, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ায় গা-ঢাকা দিয়েছিলেন রাজন।
গ্রেফতারির আগে ২০০১ সাল থেকে টানা ১৫ বছর অস্ট্রেলিয়াতেই গা-ঢাকা দিয়েছিলেন রাজন। ২০১৫-র অক্টোবরে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে গ্রেফতার হন তিনি। পাসপোর্টে তাঁর ছদ্ম পরিচয় ছিল ‘মোহন কুমার’। নামের সামান্য ভুলের জন্যই নাকি ধরা পড়তে হয়েছিল রাজেন্দ্র ওরফে রাজনকে।
যে দাউদের হাত থেকে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন ছোটা রাজন, একসময় সেই দাউদেরই অন্তর্বৃত্তের মানুষ ছিলেন তিনি। কী ভাবে? বড়া রাজন খুন হওয়ার পর সেই মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন শাগরেদ ছোটা রাজন। বড়া রাজনের হত্যাকারী আব্দুল কুঞ্জুকে হত্যার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলেও দাউদের নজরে পড়ে যান রাজেন্দ্র নিখালজে। বড় রাজনের জায়গা ফাঁকা হয়ে যাওয়ার পর দাউদ ইব্রাহিম এবং অরুণ গাওলির সংস্পর্শে আসেন ছোটা রাজন।
ধীরে ধীরে পূর্বসূরির ফেলে যাওয়া সাম্রাজ্যের কর্তৃত্বের রাশ হাতে তুলে নেন রাজন। ওই গোষ্ঠীতে থেকে ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। তাকে টপকে কোনও কারবার বা অপরাধমূলক অভিযান চালানো সম্ভব ছিল না। পরে একটি ক্রিকেট ম্যাচ চলাকালীন আব্দুল কুঞ্জুকে খুন করেন রাজেন্দ্র। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আব্দুলের উপর হামলা চালায় রাজনের দলবল।
খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, তোলাবাজি, পাচার, ছোটা রাজনের অপরাধের তালিকায় সব কিছুই ছিল। তাই তুড়ি মেরেই মুম্বাইয়ের ‘আন্ডার ওয়ার্ল্ডে’র অন্যতম মাথা হয়ে উঠতে পেরেছিলেন ছোটা রাজন। সেখান থেকে ‘ডি-কোম্পানি’র অন্দরমহলে স্থান পেয়েছিলেন তিনি। অচিরেই সেই গোষ্ঠীর মস্তিষ্ক এবং শক্তিও হয়ে উঠেছিলেন। দাউদের বিশ্বাসের পাত্র হতে খুব বেশি দিন সময় লাগেনি ক্ষুরধার মস্তিষ্কের এই অপরাধীর।
দাউদের ছত্রছায়ার কাজ করার জন্য ৮০-র দশকে দুবাইয়ে যাতায়াত শুরু করেন রাজন। দাউদের ‘ডান হাত’ হয়ে উঠতে শুরু করেন তিনি। দলে যোগ দিয়েই ডনের প্রিয় পাত্র হয়ে ওঠাকে স্বাভাবিক ভাবেই ভাল চোখে দেখেনি দাউদের দলের পুরনো গ্যাংস্টারেরা।
তখন দাউদের গোষ্ঠীতে প্রায় পাঁচ হাজার সদস্য। ছোটা রাজনের কথাতেই গোষ্ঠীতে শামিল হয়েছিলেন সাধু শেট্টি, মোহন কোটিয়ান, গুরু সাতম, রোহিত বর্মা, ইন্ডিয়া নেপালির মতো তাবড় অপরাধী। রাজনের উড়ে এসে জুড়ে বসাকে ভাল চোখে দেখছিলেন না অনেকেই। নয়া সদস্য হয়েও এমন প্রতিপত্তি বিস্তার করায় গ্যাংয়ের পুরনো সদস্যদের ঈর্ষার পাত্র হয়ে ওঠেন ছোটা রাজন।
শরদ শেট্টি, ছোটা শাকিলের মতো পুরোনো সদস্যেরা রাজনের উপর নানা কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে শুরু করেন। দলে রাজনের প্রভাব কমাতে দাউদের কানে ‘বিষমন্ত্র’ দিতে শুরু করেন তারা। এমনকি একটি পার্টিতে শরদ দাউদকে বলে বসেন ডি-কোম্পানিকে ভাঙাতে দলে বিদ্রোহ করতে পারেন রাজন। এই কথাগুলি নাড়া দিয়েছিল দাউদকে। ধীরে ধীরে রাজনকে দলীয় বৈঠক থেকে সরাতে শুরু করেন ডি-কোম্পানির মাথা। সেই সিদ্ধান্তে ক্ষুণ্ণ হন ছোটা রাজনও।
দু’জনের মধ্যে দূরত্বের সৃষ্টি হতে শুরু করে। সেই আগুনে ঘৃতাহুতি পড়ে মুম্বই বিস্ফোরণের সময়। এই হামলার আগে যে বৈঠকগুলি হয়েছিল তা থেকে ছোটা রাজনকে পুরোপুরি দূরে রেখেছিলেন দাউদ ইব্রাহিম। অন্য দিকে ছোটা শাকিল নিয়মিত সেই বৈঠকগুলোতে উপস্থিত থাকতেন। এই ঘটনাও নাড়া দিয়েছিল ছোটা রাজনকে। ১৯৯৩ সালের মার্চ মাসে মুম্বইয়ে রক্তাক্ত ধারাবাহিক বিস্ফোরণের পর দাউদ ইব্রাহিম এবং ছোটা রাজনের মধ্যে বিবাদ চরমে ওঠে। তিনি এই হামলার বিরোধিতা করেছিলেন বলে জানা যায়।
এর পর দুই ‘ডনে’ ঠোকাঠুকি লাগে। সংঘাত এমন পর্যায়ে পৌঁছোয় যে, বছর পনেরো আগে ছোটা শাকিলের নির্দেশে মুন্না ঝিংড়া ও তাঁর সহযোগীরা ছোটা রাজনের ব্যাঙ্ককের অ্যাপার্টমেন্টে হামলা করে। গুলি করে রাজনকে খুনের চেষ্টা করেছিল দাউদের লোকজন। শোনা যায় দরজা ভেদ করে একটি গুলি লেগেছিল রাজনের। সেই হামলায় মারা যান রাজনের বন্ধু রোহিত বর্মা। আহত হন রোহিতের স্ত্রী, কন্যা এবং কয়েক জন পরিচারক।
আবার কয়েকটি সংবাদ প্রতিবেদনে দাবি করা হয় প্রাণে বাঁচতে ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়েছিলেন রাজন। তাতে বেকায়দায় পড়ে গিয়ে তার শিরদাঁড়ায় বড়সড় চিড় ধরেছিল। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল। কিন্তু, সেখান থেকে প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে যান রাজন। এর পর গা-ঢাকা দেন কুখ্যাত এই মাফিয়া। বিজয় দমন, এই ভুয়ো নাম ব্যবহার করে ব্যাঙ্ককের হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল ছোটা রাজনকে।
প্রাণঘাতী হামলার খবর পেয়ে ভারত থেকে সিবিআইয়ের গোয়েন্দারা ছোটা রাজনকে গ্রেফতার করার তোড়জোড় শুরু করেন। গ্রেফতার এড়াতে ছায়াসঙ্গী ভিকি মলহোত্রের সহায়তায় সিবিআইয়ের চোখে ধুলো দিয়ে তাইল্যান্ড থেকে কর্পূরের মতো উবে যান ছোটা রাজন। খালি হাতে ফিরতে হয় সিবিআইকে।
২০০১-এই দাউদ ইব্রাহিমের এক নম্বর শাগরেদ শরদ শেট্টিকে খুন করে রাজনের লোকজন। পুলিশ বলে, ব্যাঙ্ককের হোটেলে রাজনের ওপর হামলারই বদলা ওই ঘটনা।
দাউদের ভয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন জায়গায় গা-ঢাকা দিয়েছিলেন তিনি। ছোটা রাজনের বিরুদ্ধে ‘রেড কর্নার’ নোটিস জারি করেছিল ইন্টারপোল। পয়লা নম্বর শত্রুকে খুঁজতে খুঁজতে দাউদের দল অস্ট্রেলিয়ায় ছোটা রাজনের সন্ধান পেয়ে যায় এমনটাই তথ্য এসেছিল অষ্ট্রেলিয়া সরকারের কাছে। অন্য দেশের ‘মাফিয়া ওয়ার’-এর কারণে অস্ট্রেলিয়ার বদনাম হোক তা চায়নি সে দেশের সরকার। ছোটা রাজনকে সেই দেশ ছাড়তে বলা হয়েছিল।
শেষে ঠিকানা বদলাতে রাজন সিডনি থেকে উড়ে যান বালিতে। অস্ট্রেলিয়ার কাছ থেকে গোপন তথ্য পেয়ে ছোটা রাজনকে গ্রেফতার করে ইন্দোনেশিয়া পুলিশ। ইন্দোনেশিয়ায় মোহন কুমার ছদ্মনামে নেওয়া একটি ভারতীয় পাসপোর্টসহ ধরা পড়েন রাজন। পুলিশকে দেখে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন ছোটা রাজন। পাসপোর্ট দেখানোর সময় ঘাবড়ে গিয়ে ‘মোহন কুমার’-এর বদলে নিজের আসল নাম রাজেন্দ্র নিখালজে বলে ফেলেন রাজন। তাতেই গ্রেফতার সহজ হয়ে যায় পুলিশের।
প্রায় ১৫ বছর কোথায় ‘ভ্যানিশ’ হয়ে ছিলেন ছোটা রাজন? ১৯৯৫ সালেই রাজনের নামে রেড কর্নার নোটিস জারি হয়। ইন্টারপোলের খাতায় ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ হয়ে ছিলেন টানা দু’দশক! সিডনি পুলিশ জানিয়েছে, টানা ১৫ বছর অস্ট্রেলিয়াতেই গা-ঢাকা দিয়েছিলেন রাজন। অস্ট্রেলিয়ায় থাকার আর্জি খারিজ হতেই মরিয়া হয়ে অন্য দেশে পালানোর চেষ্টা শুরু করেন রাজন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে তাঁর ব্যবসা দেখাশোনার সুবিধা হবে বলে আশ্রয় হিসাবে ইন্দোনেশিয়ার বালিকে বেছে নেন তিনি।
বুলেটপ্রুফ গাড়িতে বিশেষ নিরাপত্তার মধ্যে বালির বিমানবন্দরে নিয়ে আসা হয়েছিল ধৃত মাফিয়া ডনকে। ভারতীয় সময় সন্ধ্যা পৌনে ৮টা নাগাদ তাঁকে নিয়ে দিল্লির দিকে পাড়ি দেয় বিশেষ বিমান। রাজনের বিরুদ্ধে সব মামলা তড়িঘড়ি সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেয় মহারাষ্ট্র সরকার। রাজ্যের তরফে জানানো হয়, রাজন আন্তর্জাতিক অপরাধচক্রের সঙ্গে যুক্ত। এই ধরনের অপরাধের তদন্ত সিবিআইয়ের হাতেই থাকা উচিত।
সাংবাদিক জ্যোতির্ময় দে খুনের মামলায় ২০১৮ সালে যাবজ্জীবন জেলের সাজা হয় রাজনের। তার আগে ২০১৭ সালে পাসপোর্ট জালিয়াতি মামলায় দিল্লির বিশেষ আদালত দাউদ ইব্রাহিমের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ গ্যাংস্টারের ৭ বছর কারাদণ্ডের সাজা ঘোষণা করে। ২০১২-য় অন্ধেরীর হোটেল ব্যবসায়ী বিআর শেট্টির কাছে তোলা চেয়ে হুমকি এবং না পেয়ে গুলি করে খুনের চেষ্টার অভিযোগে ২০১৯ সালে মুম্বইয়ের ওয়াংখেড়ের বিশেষ আদালত রাজনকে ৮ বছরের জেলের সাজা দেয়।
সূত্র: আনন্দবাজার
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল