বহুল আলোচিত সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলায় টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলীর মৃত্যুদন্ড বহাল রেখে হাই কোর্টের দেওয়া রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করেছেন হাই কোর্ট।
বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান ও বিচারপতি মো. সগীর হোসেনের হাই কোর্ট বেঞ্চের ৩৭৮ পৃষ্ঠার রায়টি গতকাল সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। গত ২ জুন দেওয়া ওই রায়ে বিচারিক আদালতের রায় বহাল রেখেছিলেন হাই কোর্ট।
প্রদীপ কুমার দাশকে মাস্টার মাইন্ড ও পরিকল্পনাকারী উল্লেখ করে উচ্চ আদালত বলেছেন, ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে সে ভিকটিম মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খানের বুকের বাম পাঁজরে জুতা পরা পা দিয়ে জোরে আঘাত করে বুকের দুটি হাড় ভাঙাসহ গলার বাম পাশে জুতা পরা পা দিয়ে চেপে ধরে মৃত্যু নিশ্চিত করেছে, যা প্রসিকিউশন পক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্যসহ ময়না তদন্ত প্রতিবেদন দ্বারা প্রমাণিত। মামলায় মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের তৎকালীন পরিদর্শক বরখাস্ত লিয়াকত আলী ও টেকনাফ থানার বরখাস্তকৃত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। যাবজ্জীবন কারাদন্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের বরখাস্ত উপ-পরিদর্শক (এসআই) নন্দ দুলাল রক্ষিত, সাগর দেব, রুবেল শর্মা, টেকনাফ থানায় পুলিশের করা মামলার সাক্ষী টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরের মারিশবুনিয়া গ্রামের নুরুল আমিন, মো. নেজামুদ্দিন ও আয়াজ উদ্দিন। হাই কোর্টের রায়টি লিখেছেন বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান। রায়ে একমত পোষণ করেছেন বিচারপতি মো. সগীর হোসেন। রায়ে হাই কোর্ট বলেন, ‘ইহা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত আসামি প্রদীপ কুমার দাশ আলোচ্য হত্যাকান্ডের মাস্টার মাইন্ড, পরিকল্পনাকারী ও ঘটনার সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে সে ভিকটিম মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খানের বুকের বাম পাঁজরে জুতা পরা পা দিয়ে জোরে আঘাত করে। প্রদীপ দাশ ভিকটিমের বুকের দুটি হাড় ভাঙাসহ তার গলার বাম পাশে জুতা পরা পা দিয়ে চেপে ধরে মৃত্যু নিশ্চিত করেছে, যা প্রসিকিউশন পক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্যসহ ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন (প্রদর্শনী-১০) দ্বারা প্রমাণিত।
এ ছাড়া প্রসিকিউশন পক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্য, দন্ডপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট আসামিদের অপরাধ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ও শক্তিশালী পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য পর্যালোচনান্তে ইহা প্রমাণিত হয়েছে যে, মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত অপর আসামি লিয়াকত আলী পূর্ব পরিকল্পনা মতে ঘটনার সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে নিরস্ত্র ভিকটিম মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খানকে হত্যার উদ্দেশে তার (লিয়াকত আলীর) হাতে থাকা সরকারি পিস্তল দিয়ে ভিকটিমের শরীরের ঊর্ধ্বাংশের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে পরপর ৪টি গুলি করেছে এবং ওই গুলির আঘাতে ভিকটিমের মৃত্যু হয়েছে মর্মে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে (প্রদর্শনী-১০) উল্লেখ করা হয়েছে। রায়ে আরও বলা হয়, ‘যেহেতু আসামি প্রদীপ কুমার দাশ আলোচ্য হত্যাকান্ডের মূল পরিকল্পনাকারী এবং ঘটনার সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে ভিকটিম মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খানের বুকে আঘাত করে বুকের দুটি হাড় ভাঙাসহ গলার বাম পার্শ্বে পা দিয়ে চেপে ধরে ভিকটিমের মৃত্যু নিশ্চিত করেছে এবং যেহেতু অপর আসামি লিয়াকত আলী পূর্বপরিকল্পনামতে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে হত্যার উদ্দেশে ভিকটিমের ওপর পরপর ৪টি গুলি করেছে এবং উক্ত গুলির আঘাতেই মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খানের মৃত্যু হয়েছে মর্মে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সেহেতু আসামি প্রদীপ কুমার দাশ ও লিয়াকত আলীকে বিচারিক আদালত সঠিকভাবে দন্ডবিধির ৩০২ ধারায় বর্ণিত সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড প্রদান করেছেন।’ এ ছাড়া যাবজ্জীবন দন্ডপ্রাপ্ত আসামি এক. নন্দ দুলাল রক্ষিত, দুই. সাগর দেব, তিন. রুবেল শর্মা, চার. মো. নুরুল আমিন, পাঁচ. মো. আইয়াজ ওরফে আয়াছ ও ছয়. মো. নিজাম উদ্দিনের বিরুদ্ধে আলোচ্য হত্যাকান্ডে ষড়যন্ত্র, সহায়তা ও সাধারণ অভিপ্রায়ের অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় বিজ্ঞ বিচারিক আদালত তাদের কৃত অপরাধের ধরন বিচার-বিশ্লেষণ করে দন্ডবিধির ৩০২ ধারায় বর্ণিত মৃত্যুদন্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রদান করেছেন, যা সঠিক ও যুক্তিযুক্ত বলে আমরা মনে করি।
২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সিনহা মো. রাশেদ খান। এ ঘটনায় করা মামলার বিচার শেষে ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালত দুজনকে মৃত্যুদন্ড, ছয়জনকে যাবজ্জীবন ও সাতজনকে খালাস দিয়ে রায় দিয়েছিলেন। পরে নিয়ম অনুসারে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও পরিদর্শক লিয়াকত আলীর মৃত্যুদন্ডাদেশ অনুমোদনের জন্য (ডেথ রেফারেন্স) মামলার যাবতীয় কার্যক্রম হাই কোর্টে পাঠানো হয়। পাশাপাশি দন্ডিত আসামিরা আপিল ও জেল আপিল করেন। দন্ডের বিরুদ্ধে আসামিদের আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি শেষে ২ জুন রায় ঘোষণা করেন। রায়ে প্রদীপসহ দুই আসামির মৃত্যুদন্ড ও অপর ছয় আসামির যাবজ্জীবন কারাদন্ড বহাল রেখেছেন আদালত। এখন এ রায়ের সত্যায়িত অনুলিপি পাওয়ার পর আসামিপক্ষ আপিল বিভাগে আপিল করবে। এরপর আপিল বিভাগে মামলাটির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হবে।
