গাজায় মার্কিন নেতৃত্বাধীন মানবিক সহায়তা বিতরণ ঘিরে দীর্ঘদিন ধরে চলা বিতর্ক নতুন করে তীব্র হয়েছে। আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক নিরাপত্তা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইউজি সল্যুশনসের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো। এনডিটিভির অনুসন্ধানের দ্বিতীয় পর্বে উঠে এসেছে সংস্থাটির নিয়োগ প্রক্রিয়া, কর্মীদের আদর্শিক ঝোঁক এবং বিতর্কিত নিরাপত্তা মডেল নিয়ে নানা প্রশ্ন।
মাসের পর মাস গাজায় গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের ত্রাণ কেন্দ্রগুলোকে বলা হচ্ছিল ‘শেষ মানবিক লাইফলাইন। কিন্তু সেই কেন্দ্রগুলোতেই নথিভুক্ত হয়েছে ভয়াবহ সহিংসতা। যেখদনে ভিড় নিয়ন্ত্রণে যুক্ত ছিল মার্কিন নিরাপত্তা ঠিকাদাররা।
ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসির অনুসন্ধানে জানা যায়, গাজায় মোতায়েন ৩২০ মার্কিন নিরাপত্তাকর্মীর মধ্যে অন্তত ৪০ জন যুক্তরাষ্ট্রের কট্টর-ডানপন্থী বাইকার গ্যাং ‘ইনফিডেলস মোটরসাইকেল ক্লাব’-এর বর্তমান বা সাবেক সদস্য। অন্তত ১০ জন সদস্য সরাসরি গাজায় দায়িত্ব পালন করেছেন এবং সাতজন ছিলেন নেতৃত্বের ভূমিকায়।
বিবিসির প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গাজার টিম লিডার জনি টাজ মুলফর্ড নিজের শরীরে বহন করেন ক্রুসেডার প্রতীক ও ১০৯৫ ট্যাটু; যা প্রথম ক্রুসেড শুরুর বছর। লজিস্টিক্স সামলাচ্ছিলেন গ্যাংয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট ল্যারি জে-রড জ্যারেট। গ্যাংয়ের জাতীয় কোষাধ্যক্ষ বিল সেইন্ট সিবে ও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য রিচার্ড এ-ট্র্যাকার লফটনও নেতৃত্বে ছিলেন বিভিন্ন সাইটে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পাওয়া ছবিতে দেখা যায়, মরুভূমির পটভূমিতে রাইফেল হাতে পোজ দিচ্ছেন এসব ঠিকাদার; কেউ আবার ‘মেক গাজা গ্রেট অ্যাগেইন’-এর মতো উস্কানিমূলক ব্যানার হাতে দাঁড়িয়ে আছেন।
সমালোচনার মুখে ইউজি সল্যুশনস জানিয়েছে, ব্যক্তিগত শখ বা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকা তাদের নিয়োগে কোনো প্রভাব ফেলে না। এনডিটিভির প্রশ্নের জবাবে সংস্থাটি বলে, প্রত্যেক প্রার্থীকে কঠোর ব্যাকগ্রাউন্ড যাচাই, অস্ত্র দক্ষতা পরীক্ষা ও পেশাগত মানদণ্ডের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তাদের দাবি, চাপের মুহূর্তে শান্ত ও পরিমিত আচরণ করতে পারে এমন কর্মীই আমাদের প্রথম পছন্দ।
কিন্তু মাঠের অভিজ্ঞতা বলছে অন্য কথা। এক সাবেক ঠিকাদার বিবিসিকে জানিয়েছেন, কিছু মার্কিন কর্মী শরণার্থীদের জোম্বির ভিড় বলে অভিহিত করতেন। অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের হাতে আসা ভিডিওতে দেখা যায়, ভিড়ের দিকে নির্বিচারে গুলি ছোড়ার দৃশ্য। এক ঘটনায় একজন ঠিকাদার টানা ১৫ রাউন্ড গুলি ছোড়ার পর আরেকজনকে বলতে শোনা যায়, হেল ইয়াহ, ডিউড।
এমন অভিযোগের কেন্দ্রে থাকা মুলফর্ডের সামরিক অভিজ্ঞতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তার সাবেক সহকর্মীরা। মার্কিন সেনা অভিজ্ঞ অ্যান্থনি আগুইলার বলেন, মুলফর্ড নিজেকে অসাধারণ কমব্যাট ভেটেরান হিসেবে প্রচার করলেও বাস্তবে তার অভিজ্ঞতা সে ধরণের নয়। আগুইলার আরও অভিযোগ করেন, ইউজির কর্মীরা ইচ্ছাকৃতভাবে নিরীহ ফিলিস্তিনি বেসামরিকদের হত্যা করেছে।
গাজায় বিতর্কিত এই নিরাপত্তা মডেলকে ঘিরে আরেকটি বড় প্রশ্ন এসেছে নীতিগত দিক থেকে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ভোটে অনুমোদিত যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বাহিনী গাজায় কার্যকর হলেও এটি জাতিসংঘ নয় বরং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন নতুন বোর্ড অব পিস দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। পুনর্গঠন ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনায় এ বোর্ডের ক্ষমতা প্রায় সীমাহীন।
ইউজি সল্যুশনস জানায়, গাজায় তাদের দল কঠোর নিয়মে নন-লেথাল সরঞ্জাম ব্যবহার করেছে; পিপার স্প্রে, সাুউন্ড গ্রেনেড, মেগাফোন ইত্যাদি। তবে প্রত্যেক সদস্যের হাতে ছিল এম-৪ রাইফেল ও পিস্তল। সংস্থাটি দাবি করে, জীবন ঝুঁকিতে ফেলতে পারে এমন পরিস্থিতি ছাড়া কোনো অবস্থাতেই আমরা প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করি না।
কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, গাজায় এই মডেল নজিরবিহীন। কারণ মার্কিন কোনো সরকারি চুক্তি ছাড়াই বিদেশি সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি নিরাপত্তাকর্মীরা এভাবে সশস্ত্র দায়িত্ব পালন করেছেন।
মাঠের কর্মীদের ভাষ্যে যে চিত্র উঠে এসেছে, তা আরও বিভীষিকাময়। সীমিত খাদ্যসামগ্রী পাওয়ার আশায় কয়েক হাজার মানুষ একত্র হলে গুলির শব্দে ভিড় ছত্রভঙ্গ হয়, কেউ কেউ গেটের নিচে চাপা পড়ে। অভিযোগকারীরা বলছেন, ভিড় কাছে এলে গুলি চালাতে কর্মীদের উৎসাহ দেওয়া হতো। তবে সংস্থাটি সব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
গাজায় সহায়তা বিতরণের নামে যে ‘সামরিকীকৃত মানবিকতার’ মডেল দাঁড়িয়েছে, তা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে নতুন করে ভাবাচ্ছে। বিতর্ক থামেনি; বরং প্রতি নতুন তথ্যের সঙ্গে আরও গভীর হচ্ছে প্রশ্ন, মানবিক ত্রাণ কার্যক্রম কি এভাবে সামরিক শক্তির ওপর নির্ভর করতে পারে?
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল