গুম-অপহরণের পর র্যাবের টাস্কফোর্স ইন্টারোগেশন (টিএফআই) সেল ও সেনাবাহিনীর জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে (জেআইসি) আটকে নির্যাতনের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের দুই মামলার ‘আনুষ্ঠানিক অভিযোগ’ গঠনের শুনানির দিন ধার্য করা হয়ছে। টিএফআই সেল সংক্রান্ত মামলার অভিযোগ গঠনের শুনানি আগামী ৩ ডিসেম্বর। আর জেআইসি সেল সংক্রান্ত মামলার অভিযোগ গঠনের শুনানি ৭ ডিসেম্বর। বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ আদেশ দেন।
এ দুই মামলায় পলাতক আসামি শেখ হাসিনার পক্ষে মামলা লড়তে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্নাকে নিয়োগ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। পাশাপাশি পলাতক অন্য আসামিদের জন্যও রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এদিকে, সেনা কর্মকর্তাদের ভার্চুয়াল হাজিরা সংক্রান্ত এক আবেদনের বিষয়ে ‘মন্ত্রী-বিচারপতিরা হাজির হলে সেনা কর্মকর্তারা কেন পারবেন না’ বলে আইনজীবীকে প্রশ্ন করেন ট্রাইব্যুনাল। পরে এ বিষয়ে পৃথক দুই আবদেনর শুনানির জন্য ৩ ও ৭ ডিসেম্বর দিন ঠিক করা হয়েছে। অন্যদিকে সেনা কর্মকর্তাদের ট্রাইব্যুনালে হাজিরাকে কেন্দ্র করে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। নিয়মিত দায়িত্বপালনকারী আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যের পাশাপাশি এদিন ট্রাইব্যুনাল এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। পাশাপাশি সেনা বাহিনী, বিজিবি ও র্যাবের অতিরিক্ত সদস্যদেরও দেখা গেছে ট্রাইব্যুনালের দুটি প্রবেশ পথেই। সকাল ৯টা ৫৮ মিনিটে কারা কর্তৃপক্ষের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রিজনভ্যানে করে কারাগারে আনা হয় গ্রেপ্তার ১৩ সেনা কর্মকর্তাকে। এর মধ্যে টিএফআই সেলের ঘটনায় করা মামলায় ১০ জন ও জেআইসির ঘটনার মামলায় তিনজন আসামি রয়েছেন। বেলা ১১টা ২০ মিনিটে বিচারপতিরা এজলাসে উঠলে মামলার কার্যক্রম শুরু হয়।
টাস্কফোর্স ফর ইন্টারোগেশন সেলে (টিএফআই সেল) গুম করে রাখার ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলায় শেখ হাসিনাসহ মোট ১৭ জন আসামি। এর মধ্যে ১০ জন গ্রেপ্তার আছেন। তারা হলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. কামরুল হাসান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহাবুব আলম, ব্রিগেডিয়ার কে এম আজাদ, কর্নেল আবদুল্লাহ আল মোমেন, কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান (অবসর প্রস্তুতিমূলক ছুটিতে), লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মশিউর রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল ইসলাম সুমন ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. সারওয়ার বিন কাশেম।
জুলাই-আগস্ট গণ অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এই আসামিদের প্রথম সাতজন র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক হিসেবে এবং শেষের তিনজন র্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাদের গতকাল ট্রাইব্যুনালে আনা হয়। এ মামলায় শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকসহ সাত আসামি পলাতক।
জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে (জেআইসি) গুম করে রাখার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের আরেকটি মামলায় শেখ হাসিনাসহ ১৩ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে তিন আসামি গ্রেপ্তার আছেন। তারা হলেন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) সাবেক তিনজন পরিচালক মেজর জেনারেল শেখ মো. সরওয়ার হোসেন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমান সিদ্দিকী ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমেদ তানভির মাজাহার সিদ্দিকী। তাদেরও গতকাল ট্রাইব্যুনালে আনা হয়। এ মামলায় শেখ হাসিনার সঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকসহ ১০ আসামি পলাতক।
গত ৮ অক্টোবর এ দুই মামলায় প্রসিকিউশনের দাখিল করা ‘আনুষ্ঠানিক অভিযোগ’ আমলে নিয়ে মোট ২৮ জন আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। পরোয়ানা জারির পর গত ২২ অক্টোবর আসামি ১৩ সেনা কর্মকর্তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হলে, ট্রাইব্যুনাল তাদের কারাগারে রাখার নির্দেশ দেন। এরপর থেকে তাদের ঢাকা সেনানিবাসে সরকার ঘোষিত সাবজেলে রাখা হয়। গতকাল সেখান থেকে তাদের ট্রাইব্যুনালে আনা হয়।
বিচারপতি-মন্ত্রীরা হাজির হলে, সেনা কর্মকর্তারা কেন পারবেন না :
সাবেক প্রধান বিচারপতি ও সাবেক মন্ত্রীরা সশরীরে ট্রাইব্যুনালে হাজির হতে পারলে গ্রেপ্তার সেনা কর্মকর্তারা কেন পারবেন না, তাদের আইনজীবীকে সে প্রশ্ন করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ভার্চুয়াল হাজিরা চেয়ে সেনা কর্মকর্তাদের করা আবেদন উপস্থাপন করা হলে এমন প্রশ্ন করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। এ সময় আইন সবার জন্য সমান বলেও মন্তব্য করেন ট্রাইব্যুনাল। পরে এ বিষয়ে পৃথক দুই আবেদনের শুনানির জন্য ৩ ডিসেম্বর দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
সেনা কর্মকর্তাদের আইনজীবী ব্যারিস্টার হামিদুল মিসবাহ আসামিদের ভার্চুয়াল হাজিরা সংক্রান্ত আবেদন উপস্থাপন করে শুনানির জন্য দিন ধার্য করতে সময় নির্ধারণের আর্জি জানান। এ সময় ট্রাইব্যুনাল বলেন, এসব আবেদন আমরা নিতে চাই না। আপনারা আজকেই শুনানি করুন। ট্রাইব্যুনাল বলেন, ‘বিভিন্ন মামলায় সাবেক প্রধান বিচারপতি কারাগারে রয়েছেন। তিনি সশরীরে হাজির হচ্ছেন। আপিল বিভাগের সিনিয়র মোস্ট বিচারপতি নিয়মিত হাজির হচ্ছেন। সাবেক কয়েকজন মন্ত্রীও সশরীরে নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছেন। উনারা (সেনা কর্মকর্তা) কেন পারবেন না। তারা কি এসবের বাইরে। ল’ ইজ ইকুয়্যাল ফর অল। অর্থাৎ আইন সবার জন্য সমান। আপনাদের সমস্যা থাকলে সরকারকে বলুন মামলা উঠিয়ে নিতে।’
হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী জেড আই খান পান্না : আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের শুনানির দিন ধার্য করার পাশাপশি গতকাল ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনা, তারিক আহমেদ সিদ্দিক ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ পলাতক আসামিদের পক্ষে রাষ্ট্রীয় খরচে আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে দুজন আইনজীবীর নাম জানা গেছে। তারা হলেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না ও এম হাসান ইমাম। আইনজীবী পান্না লড়বেন শেখ হাসিনার পক্ষে; আর আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে লড়বেন আইনজীবী এম হাসান ইমাম। বাকি পলাতক আসামিদের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবীর নাম উল্লেখ করেননি ট্রাইব্যুনাল। পরে এসব আইনজীবীর নাম জানিয়ে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।
শেখ হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত হওয়ার পর আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, ‘আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। একাত্তরে যুদ্ধ করেছি আমি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে, তার আহ্বানে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। তো তার কন্যা উইদাউট প্রপার ডিফেন্স (নিজের পক্ষে যথাযথ আইনজীবী ছাড়া), আগেরটাও (মানবতাবিরোধী অপরাধের যে মামলায় মৃত্যুদন্ড হয়েছে) প্রপার ডিফেন্স ছিল, আমি কাউকে ছোট করতেছি না, আমার কাছে মনে হচ্ছে তাকে আরও প্রোপার ওয়েতে ডিফেন্স দেওয়া দরকার। দ্যাটস ওয়াই, আমি স্টেট ডিফেন্সে।