গোটা দেশে এখন নির্বাচনি আমেজ সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমান অন্তর্র্বর্তী সরকারের মেয়াদ আছে তিন মাস। গত দেড় বছরে বেশি সময় ধরে এই সরকার যে সব ক্ষেত্রে সফল হয়েছে এমনটা নয়। সরকারের সাফল্য এবং ব্যর্থতা দুটোই আছে। তবে, দু-একজন উপদেষ্টাকে নিয়ে বিতর্ক চলছে শুরু থেকেই। এই কয়েকজন উপদেষ্টা সরকারকে বিভিন্ন সময়ে বিব্রত করেছেন। বিশেষ করে দুজন ছাত্র উপদেষ্টা নানা বিতর্কে জড়িয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। নির্বাচনের আগে এ দুই উপদেষ্টা যে কোনো রাজনৈতিক দলে ঢুকে নির্বাচন করতে চাইছেন। এটা হবে প্রচ- ক্ষতিকারক এবং আত্মঘাতী একটি সিদ্ধান্ত।
বিতর্কিত উপদেষ্টারা যদি কোনো রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচন করেন তাহলে কেবল ওই রাজনৈতিক দলই বিতর্কিত হবে না। এই সরকার এবং গোটা নির্বাচনই প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এর ফলে একদিকে যেমন মনে হবে রাজনৈতিক দলটি সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে নির্বাচনে জয়ী হয়েছে অন্যদিকে এটাও মনে হবে, ওই বিশেষ রাজনৈতিক দলকে জয়ী করতেই সরকার কাজ করেছে। এটা গণতন্ত্রের জন্য একটি চরম রাজনৈতিক সংকট তৈরি করবে।
বিতর্কিত উপদেষ্টাদের নিয়ে কিছু দিন ধরেই রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক চলছে। সরকারের পক্ষ থেকে এই দুই উপদেষ্টাকে পদত্যাগ করতে বলা হলেও তারা পদত্যাগ করেননি। উপরন্তু একজন উপদেষ্টা প্রকাশ্যে বলেছেন, আগামী নির্বাচনে তিনি অংশগ্রহণ করবেন। নির্বাচনের নব্বই দিনেরও কম সময় বাকি। জাতীয়সংসদ নির্বাচনের মাত্র তিন মাসের কম সময়ের আগে এ সরকারকে অবশ্যই পুরোপুরি নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে হবে। নির্বাচনকালীন সরকারের একটি অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, রুটিন দায়িত্ব পালন করা। এই সময়ে সরকার কোনো নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে না। এটাই গণতন্ত্রের নিয়ম। এমনকি যেসব উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নেই, সেই সব দেশেও নির্বাচনের নব্বই দিন আগে থেকে সরকারের কার্যক্রম গুটিয়ে ফেলা হয়। রুটিন দায়িত্বের মধ্যে সরকারের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখা হয়।
এই সময়ে যদি সরকারের একজন উপদেষ্টা নির্বাচনে অংশগ্রহণের ইচ্ছা পোষণ করেন তাহলে তার সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালনের নৈতিক অধিকার থাকে না। এই উপদেষ্টা যে দলে যোগ দেবেন সেই দলই বিতর্কিত হবে। উপদেষ্টা বিএনপি, জামায়াত যে দলেই যোগদান করুন না কেন, তার সব দোষ-ত্রুটি এবং বিতর্কিত কাজের দায়ভার বর্তাবে ওই রাজনৈতিক দলের ওপর।
জুলাই গণ অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত বছরের ৮ আগস্ট অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্র্বর্তী সরকার গঠিত হয়। বর্তমানে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য প্রধান উপদেষ্টাসহ ২৩ জন। উপদেষ্টা পরিষদ গঠনে তখন বিভিন্ন দলের কাছ থেকে নাম নেওয়া হয়েছিল। ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে শুরুতে স্থান পেয়েছিলেন দুজন।
শুরুতে উপদেষ্টা পরিষদের নিরপেক্ষতা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো বড় কোনো প্রশ্ন তোলেনি। কয়েকজন উপদেষ্টার দপ্তর বদল ছাড়া পরিষদে তেমন কোনো পরিবর্তনও আসেনি।
কিন্তু দুই উপদেষ্টা শুরু থেকেই নানা বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। অস্ত্র নিয়ে বিতর্কে জড়ান এক উপদেষ্টা। এই উপদেষ্টাই তাঁর নিজ এলাকায় অস্বাভাবিক বরাদ্দ দিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েন। তার পিতার নামে ঠিকাদারি লাইসেন্স দিয়ে তিনি আবারও সমালোচিত হন। এরকম অনেক বিতর্কিত ঘটনার জন্ম দেওয়া এই উপদেষ্টা বিএনপি বা জামায়াত- যে দলেই যোগদান করুক না কেন, সেই দলের ক্ষতি ছাড়া লাভ হবে না।
আরেক ছাত্র উপদেষ্টা, সমালোচিত নানা বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য। মাঝে মাঝেই তিনি ফেসবুকে নানা ধরনের মন্তব্য করে বিতর্ক সৃষ্টি করেন। তার এসব মন্তব্যের কারণে সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। টেলিভিশন লাইসেন্স কেলেঙ্কারি ছাড়াও নানা ধরনের অভিযোগ রয়েছে এই উপদেষ্টার বিরুদ্ধে। গত মাসে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে ‘দলঘনিষ্ঠ’ উপদেষ্টাদের বাদ দেওয়ার কথা বলে বিএনপি। দুই ছাত্র প্রতিনিধি উপদেষ্টা নিয়ে তাদের অভিযোগ আগে থেকেই ছিল। এবার তারা অন্য একজন উপদেষ্টাকে নিয়ে আপত্তি করে। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে জামায়াতে ইসলামীও সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টার বিরুদ্ধে বিএনপির পক্ষে কাজ করার অভিযোগ করে। জামায়াত কারও নাম উল্লেখ করেনি।
একই দিন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলাদা বৈঠকে এনসিপি নেতারা প্রয়োজন হলে শুধু ছাত্র উপদেষ্টা নন, বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী উপদেষ্টাদের বাদ দেওয়ার দাবি তোলেন। সরকারকে এসব বিতর্কিত উপদেষ্টাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে দ্রুত। বিএনপি, জামায়াতসহ রাজনৈতিক দলগুলোকেও এসব উপদেষ্টাদের দলে আশ্রয় না দেওয়ার ব্যাপারে পরিষ্কার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা উচিত। এরা যদি কোনো দলে যোগ দেয় তাহলে সেই দলকে এদের সব অপকর্মের দায় বহন করতে হবে। রাজনৈতিক দল এরকম সিদ্ধান্ত নিলে ক্ষতি হবে গণতন্ত্রের, সুস্থ রাজনীতির।