বাংলাদেশে স্মার্ট হোম অ্যাপ্লায়েন্স বাজার দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। নগর থেকে গ্রাম সব জায়গায় মানুষ এখন স্মার্ট টিভি, স্মার্ট ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, এয়ার কন্ডিশনারসহ বিভিন্ন ডিজিটাল ডিভাইসের ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে উঠছে। এলজি, কনকা, হাইকো, বাটারফ্লাই, ওয়ালটন, মিনিস্টার, স্যামসাং, হিটাচি, র্যাংগ্স, সনি, শার্পসহ জনপ্রিয় ব্র্যান্ডগুলো এ প্রযুক্তি বিপ্লবের পথ তৈরি করে দিয়েছে। এ প্রবণতা শুধু বিনোদন ও আরাম বাড়ায়নি; বরং সময়, শ্রম ও বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের মাধ্যমে মানুষের জীবনযাত্রায় এনেছে দৃশ্যমান পরিবর্তন। ডিজিটাল ডিভাইস এখন আর বিলাস নয়, দৈনন্দিন প্রয়োজন। দ্রুত কাজ, ঝামেলাহীন সমাধান, অ্যাপ কন্ট্রোল, বিদ্যুৎ ও সময় সাশ্রয় হওয়ায় গ্রাহকদের প্রযুক্তিনির্ভর আচরণ কোম্পানিগুলোকে নতুন উদ্ভাবনে উৎসাহিত করছে। একটি স্মার্ট হোমে, ফ্রিজ, টিভি, লাইট, ফ্যান, ডোর লক, সিকিউরিটি সিস্টেম, এসি, ওয়াশিং মেশিন সবকিছুই এক অ্যাপ থেকে নিয়ন্ত্রণযোগ্য। এসি ভুলে চালু রেখে বের হয়ে গেলেও মোবাইল থেকে বন্ধ করা যাবে। ফ্রিজের তাপমাত্রা বা ওয়াশিং মেশিনের লন্ড্রি শেষ হয়েছে কি না সবই দেখা যাবে রিয়েল টাইমে। তবে গ্রামীণ এলাকায় সচেতনতা তুলনামূলক কম হওয়ায় কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এজন্য সার্ভিস নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন ভোক্তারা ও খাতসংশ্লিষ্টরা। কারণ তথ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে প্রযুক্তি আরও সহজলভ্য হচ্ছে দ্রুত। কোম্পানিগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বিশ্বমানের ব্র্যান্ডগুলো ডেটা এনক্রিপশন, সুরক্ষিত ক্লাউড, ব্যবহারকারীর তথ্য গোপনীয়তার নিশ্চয়তার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সতর্ক। এনার্জি সাশ্রয়ে স্মার্ট প্রযুক্তি, স্মার্ট ফ্রিজ কম বিদ্যুৎ নেয়, স্মার্ট ওয়াশিং মেশিন কম পানি ব্যবহার করে, স্মার্ট এসি প্রয়োজন অনুযায়ী ঠান্ডা করে এবং ভুলে চালু থাকলে বন্ধ করার সুযোগ রয়েছে। এভাবে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি বিস্তৃতি পাচ্ছে। এআই প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। টিভিতে কনটেন্ট সাজেশন, ফ্রিজে কুলিং অপ্টিমাইজেশন, ওয়াশিং মেশিনে ফ্যাব্রিক অনুযায়ী সেটিং ও অ্যাপ কন্ট্রোলড হোম ইন্টিগ্রেশন। বাংলাদেশের কোম্পানিগুলোও নিজেদের মডেলে এসব যুক্ত করছে। এ বিষয়ে ইলেক্ট্রো মার্ট গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নুরুল আফছার বলেন, স্মার্ট হোম বা আইওটি ভবিষ্যতে ‘প্রযুক্তি বিপ্লব’ তৈরি করবে। সব ইলেকট্রনিকস ডিভাইস একটি কেন্দ্রীয় সিস্টেমে যুক্ত থাকবে। স্মার্টফোন, স্মার্টওয়াচ বা ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট দিয়ে দূর থেকেও বাড়ির সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। সেন্সর প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডিভাইসগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিদ্যুৎ সাশ্রয় করবে। ফ্রিজ খাবারের স্টক পর্যবেক্ষণ করে প্রয়োজনীয় জিনিস স্বয়ংক্রিয়ভাবে অর্ডার দেওয়ার সক্ষমতাও অর্জন করবে। তাঁর মতে, স্মার্ট হোম প্রযুক্তি জীবনকে আরও দক্ষ, সুবিধাজনক এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে স্বয়ংক্রিয় করে তুলবে। স্মার্ট ইলেকট্রনিকস পণ্য তৈরি ও বাজারজাত করতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতি উৎপাদন খরচ বাড়ায়। দক্ষ জনবল সংকট উন্নত প্রযুক্তি উৎপাদনে বাধা সৃষ্টি করে। নীতিমালা ও নিয়ন্ত্রক জটিলতা, শুল্ক কাঠামো এবং বিনিয়োগ নিরাপত্তার অনিশ্চয়তা শিল্পকে ধীর করে দেয়। ই-বর্জ্য ম্যানেজমেন্টের অভাবও একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেন, চ্যালেঞ্জ থাকলেও ভোক্তা চাহিদা বৃদ্ধি ও সরকারের সহায়ক নীতির কারণে বাজারের সম্ভাবনা অনেক। স্মার্ট প্রযুক্তি শক্তি সাশ্রয় ও পরিবেশবান্ধব জীবন নিশ্চিত করছে। গ্রী এয়ার কন্ডিশনারের স্মার্ট থার্মোস্ট্যাট ব্যবহারকারীর রুটিন অনুযায়ী স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে বিদ্যুৎ সাশ্রয় করে। কনকা, গ্রী ও হাইকোর পণ্যে আধুনিক এনার্জি ইফিশিয়েন্ট প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়, যা পরিবেশবান্ধব ও ব্যয় সাশ্রয়ী। ইনভার্টার কম্প্রেসর ও স্বয়ংক্রিয় অপারেশন পদ্ধতি শক্তির অপচয় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কমাতে সহায়তা করে।
স্মার্ট হোম প্রযুক্তি কীভাবে বদলে দিচ্ছে জীবন : স্মার্ট টিভিতে কোনো কনটেন্ট খোঁজার ঝামেলা নেই। ভয়েস কমান্ড, অনলাইন ক্লাস ও মিটিং, ওভার দ্য টপ (ওটিটি) অ্যাপ সুবিধা রয়েছে। স্মার্ট ফ্রিজের ইনভার্টার কম্প্রেসর, ডোর কুলিং, ডিসপ্লে দিয়ে টেম্পারেচার দেখা ও ভিতরের খাবার দরজা না খুলেও দেখা যায়। স্মার্ট ওয়াশিং মেশিনে স্বয়ংক্রিয় ডিটারজেন্ট নিয়ন্ত্রণ, সঠিক ফ্যাব্রিক অপশন, অল্প পানি, বিদ্যুৎ ব্যবহার ও কাপড় শুকানো পর্যন্ত সুবিধা রয়েছে। স্মার্ট এয়ার কন্ডিশনার অ্যাপ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। বাড়ির বাইরে থেকেও চালু ও বন্ধ করার সুবিধা রয়েছে। এনার্জি সেভ মোড ও ফিল্টার মনিটরিং সুবিধা রয়েছে।
আগামী ১০ বছরে স্মার্ট বাংলাদেশ : আরও স্মার্ট হোম অ্যাপ্লায়েন্স তৈরিতে শক্তিশালী স্থানীয় ইলেকট্রনিকস শিল্পগুলো। এআই ও আইওটিনির্ভর উৎপাদন, এনার্জি সেভিং প্রযুক্তির বিস্তার, রপ্তানি বৃদ্ধির নতুন দিগন্ত উন্মোচন। সামগ্রিকভাবে স্মার্ট প্রযুক্তি বাংলাদেশের ঘরোয়া জীবনকে দক্ষ, সাশ্রয়ী এবং ভবিষ্যৎবান্ধব করে তুলছে। বাংলাদেশে রেফ্রিজারেটর বাজারে ৯৫ শতাংশ দখল করেছে স্থানীয় ব্র্যান্ড। বাজার বিশেষজ্ঞদের মতে, স্মার্ট অ্যাপ্লায়েন্সের ক্রমবর্ধমান চাহিদা দেখিয়ে দেয় বাংলাদেশ এখন আর আমদানিনির্ভর নয়; বরং নিজস্ব উৎপাদন ক্ষমতা দিয়ে একটি বড় শিল্প গড়ে তুলছে। বাটারফ্লাই গ্রুপের ডিজিএম ও হেড অব প্রোডাক্ট এ এস এম মুনতাসির চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশি গ্রাহকরা এখন অনেক বেশি প্রযুক্তিগতভাবে সচেতন। তাই চ্যালেঞ্জ কম, বরং সুযোগই বেশি। গ্রাহকদের বোঝাতে পারলে তারা সহজেই নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করেন বিশেষত যদি তা সময় বাঁচায়, জ্বালানি সাশ্রয় করে এবং দৈনন্দিন কাজ সহজ করে। বাটারফ্লাই বিশ্বের শীর্ষ ব্র্যান্ডগুলোর সঙ্গে কাজ করায় তথ্য নিরাপত্তা সর্বদাই অগ্রাধিকার পায় বলে জানান তিনি। স্মার্ট প্রযুক্তিতে ডেটা সিকিউরিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এবং আমাদের আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড পার্টনাররা নিরাপত্তা নিশ্চিতে সর্বোচ্চ মান বজায় রাখি। মুনতাসির চৌধুরী বলেন, স্মার্ট ডিভাইস কম এনার্জি ব্যবহার করে। এগুলো প্রয়োজন অনুযায়ী কাজ করে। ফলে অপচয় কম হয়। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, স্মার্ট ফ্রিজ কম বিদ্যুৎ খরচ করে। স্মার্ট ওয়াশিং মেশিন কম পানি ব্যবহার করে এবং নির্দিষ্ট সময়েই কাজ শেষ করে। স্মার্ট এসি এনার্জি সেভ মোডে চলে এবং বাইরে থেকেও বন্ধ করা যা। বাংলাদেশে স্যামসাং, এলজি, সনি, শার্প, হিটাচি ও র্যাংগ্স দীর্ঘদিনের প্রতিষ্ঠিত। বাটারফ্লাই এলজির স্থানীয় অংশীদার হিসেবে স্মার্ট ওয়াশিং মেশিন ও স্মার্ট টিভির বাজার শক্তিশালী করে তুলেছে। বিশেষ করে এলজির ওএলইডি স্মার্ট টিভি ও থিংককিউ এআই ফিচার মূল্য ও মানের দিক থেকে বিলাসী গ্রাহকদের কাছে বিশেষ জনপ্রিয়। স্মার্ট ফ্রিজ ব্যবহারকারী মোসলেম উদ্দিন বলেন, আমার ঘরে এখন কনকার ফ্রিজ। এআই ফিচারের কারণে ব্যবহার সহজ হয়েছে, আর বিদ্যুৎ বিলও আগের চেয়ে কম। ভাবিনি গ্রামে এমন প্রযুক্তি পাওয়া যাবে। ঢাকার কর্মজীবী নারী সাবিনা আক্তার বলেন, আমি বাটারফ্লাই স্মার্ট ওয়াশিং মেশিন কিনেছি। আগেরটার তুলনায় পানি ও বিদ্যুৎ দুটোই কম লাগে। ব্যস্ত সময়ে মাইক্রোপ্রোগ্রাম চালিয়ে সহজেই লন্ড্রি শেষ করতে পারছি। রাকিব রহমান বলেন, এলজির ওএলইডি টিভির ছবির মান অসাধারণ। তবে কনকা ও হাইকোর বাজেট ফ্রেন্ডলি অপশনগুলো দারুণ। এই ব্র্যান্ডগুলো সার্ভিস দিয়েও ভালো অবস্থানে আছে।