১২ জুন, ২০২৫। আহমেদাবাদ বিমানবন্দর থেকে ওড়ার ৪৫ সেকেন্ডের মধ্যেই ভেঙে পড়ে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার। লন্ডনগামী এই ফ্লাইট দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান কমপক্ষে ২৭০ জন। এই দুর্ঘটনার পর থেকেই একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে—ভারতের আকাশপথ আসলে কতটা নিরাপদ?
ভারতের ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ সিভিল এভিয়েশন (ডিজিসিএ)-এর প্রধান ফৈজ আহমেদ কিদোয়াই জানিয়েছেন, ভারতের আকাশ সবসময়ই নিরাপদ ছিল, এখনও আছে। আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থার (আইসিএও) রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রতি মিলিয়ন ফ্লাইটে দুর্ঘটনার সংখ্যা ভারতের ক্ষেত্রে বিশ্ব গড়ের চেয়েও কম।
তবে তিনি স্বীকার করেছেন, ২০১০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে মাত্র দু'বছর ভারতের পারফরম্যান্স গড়ের চেয়ে খারাপ ছিল, আর সেই বছরগুলিতেই বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে।
২০১০ সালের মাঙ্গালোর দুর্ঘটনায় ১৫৮ জন মারা যান, ২০২০ সালের কোঝিকোড় দুর্ঘটনায় প্রাণ যায় ২১ জনের। আর এবার ২০২৫ সালের জুনে আরও ভয়াবহ বিপর্যয়। গত ১৫ বছরে তিনটি বড় দুর্ঘটনা ভারতের বিমান নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলছে।
সম্প্রতি, স্পাইসজেট-কে ঘিরে একাধিক উদ্বেগজনক তথ্য সামনে এসেছে। ব্রিটেনের কোম্পানি ডাউটি প্রোপেলার্স দুটি কিউ৪০০ টার্বোপ্রপ বিমানে অভ্যন্তরীণ বিয়ারিংয়ের ক্ষতি চিহ্নিত করে জানায়, সমস্যার মূলে না গিয়ে স্পাইসজেট শুধু বেশি গ্রিজ দিয়ে সমাধানের চেষ্টা করছিল।
ডিজিসিএ এপ্রিল মাসে নিজস্ব অডিট চালিয়ে আরও ‘ঘাটতি ও অনিয়ম’ খুঁজে পায়। কিদোয়াই জানিয়েছেন, আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি, দায়িত্বপ্রাপ্তদের বরখাস্ত করেছি, কয়েকজনকে সাসপেন্ডও করেছি।
এবার শুধু স্পাইসজেট নয়, প্রশ্ন উঠেছে এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেসের বিরুদ্ধেও। সংস্থাটি একটি এ৩২০ বিমানে ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ প্রতিস্থাপন দেরি করে এবং রেকর্ডে ভুল তথ্য দেয়। ডিজিসিএ সূত্রে জানা গেছে, সংস্থাটি ভুল স্বীকার করে 'প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা' নিয়েছে।
মে মাসে দিল্লি-শ্রীনগর ইন্ডিগো ফ্লাইটটি ভয়াবহ টার্বুলেন্সে পড়ে, যার ফলে বিমানের নাকের অংশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়, ওভারহেড বিন খুলে যায়। ২২২ যাত্রী নিয়ে অবতরণ হয় ঠিকঠাক, তবে দুই পাইলটকে বহিষ্কার করা হয়।
ডিজিসিএ এখন নতুন নির্দেশিকা জারি করেছে—আবহাওয়াজনিত বিপদের ক্ষেত্রে কত নটিক্যাল মাইল দূর থেকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।
২০২০ থেকে ২০২৫-এর জানুয়ারি পর্যন্ত দেশের বিমান সংস্থাগুলো মোট ২ হাজার ৪৬১টি যান্ত্রিক ত্রুটি রিপোর্ট করেছে। এর মধ্যে ইন্ডিগো একাই ১ হাজার ২৮৮টি, স্পাইসজেট ৬৩৩টি, আর এয়ার ইন্ডিয়া ও এর সহযোগী সংস্থা মিলিয়ে ৩৮৯টি।
কিদোয়াই বলছেন, ত্রুটি রিপোর্ট করা বাড়ছে—এটা ভালো লক্ষণ। চুপ করে রেখে উড়ানের চেয়ে, সমস্যার কথা জানানোটাই নিরাপদ।
যাত্রীসংখ্যা ও উড়ানের পরিমাণ বাড়লেও, ফ্লাইটের টার্নঅ্যারাউন্ড টাইম একই থাকায় রক্ষণাবেক্ষণের সময় কমে যাচ্ছে কি না, তা নিয়েও ভাবছে ডিজিসিএ।
ভারত এখন বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম যাত্রীবাহী বিমান বাজার। অথচ গত দুই বছরে বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রকের বাজেট কাটছাঁট করা হয়েছে। এই মুহূর্তে ৮৫০টি বিমান পরিচালনা করছে দেশের বিভিন্ন নির্ধারিত এয়ারলাইন। ২০১৫ সালে সংখ্যাটি ছিল প্রায় ৪০০।
এছাড়া, বেসরকারি অপারেটর ও হেলিকপ্টার পরিষেবা মিলিয়ে ১ হাজার ২৮৮টি বিমানের অপারেশন চলছে দেশে। দশকের শেষে সেই সংখ্যা ২ হাজার ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
সাম্প্রতিক দুর্ঘটনার ফলে কি মানুষ বিমানে উঠতে ভয় পাচ্ছেন? ফৈজ কিদোয়াই বলছেন, তথ্য বলছে—না। যাত্রীসংখ্যায় বড় রকমের পতন হয়নি। সামান্য একটা ডিপ দেখা গেছে কয়েকদিনের জন্য, সেটাও স্বাভাবিক।
সূত্র: বিবিসি
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল