কিছু আন্তর্জাতিক মহল নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টির চেষ্টা করছে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, কিছু শক্তি চায় নির্বাচন যেন না হয়। আমরা জানি না তারা কার জন্য কাজ করছে। বিপুল পরিমাণ টাকা ঢালা হচ্ছে; যার সুবিধাভোগীরা দেশের ভিতরে এবং বাইরে রয়েছে। তারা ভালোভাবে প্রস্তুত, এটাই সবচেয়ে বিপজ্জনক বিষয়। সামনের কয়েকটা মাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গত সোমবার নিউইয়র্কের একটি হোটেলে রবার্ট এফ কেনেডি মানবাধিকার সংস্থার সভাপতি কেরি কেনেডির নেতৃত্বে শীর্ষ মানবাধিকার প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে তিনি এ বলেন। এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চলে এ বৈঠক। পরে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বৈঠকের বিস্তারিত গণমাধ্যমকে জানায়। এদিকে গতকাল জাতিসংঘ সদর দপ্তরের সাধারণ পরিষদ হলে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি নিয়ে উচ্চপর্যায়ের আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে অন্তত ৭৫টি দেশ ও সংস্থার প্রতিনিধি অংশ নেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানও ছিলেন। সম্মেলনে রোহিঙ্গাদের শান্তিপূর্ণ প্রত্যাবাসনের পক্ষে একমত পোষণ করেন বিশ্বনেতারা।
রবার্ট এফ কেনেডি মানবাধিকার সংস্থার সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘আমরা চাই ফেব্রুয়ারিতে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ একটা নির্বাচন হবে। এমন নির্বাচন হবে যা বাংলাদেশে আগে কখনো হয়নি। বছরের পর বছর সত্যিকারের যে ভোটাররা ভোট দিতে পারেননি, এবার আমরা তাদের স্বাগত জানাতে চাই, বিশেষ করে নারীদের। আমাদের লক্ষ্য দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করা। কিন্তু নির্বাচন যাতে কখনো না হয় তা নিশ্চিত করতে কিছু শক্তি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এজন্য প্রচুর অর্থ খরচ করা হচ্ছে।’
অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে কথা বলার আহ্বান জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, চুরি হওয়া অর্থ উদ্ধারের আইনি প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল। আশা করি মানবাধিকার সংস্থাগুলো এ বিষয়ে আওয়াজ তুলবে, যাতে ব্যাংকগুলো চুরির অর্থ লুকিয়ে রাখতে না পারে।
প্রধান উপদেষ্টা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে সংস্কারের জন্য ১১টি কমিশন গঠন করার কথা উল্লেখ করে বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এরই মধ্যে সংস্কার প্রস্তাবসমূহ পর্যালোচনা করছে। আশা করছি, জুলাই সনদে অন্তর্ভুক্ত গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক সংস্কারগুলো অক্টোবরের মধ্যে খসড়া আকারে তৈরি হবে এবং রাজনৈতিক দলগুলো তাতে স্বাক্ষর করবে। বৈঠকে মানবাধিকার কর্মীরা মানুষের মানবাধিকার সুরক্ষায় নিরাপত্তা সেক্টরের সংস্কারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়াবিষয়ক পরিচালক জন সিফটন বলেন, বেশিসংখ্যক সংস্কার নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে, যেন সংসদ গঠনের পরও তারা এই প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখে।
সোমবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা আগামী কয়েক মাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে জাতিসংঘের সহযোগিতা কামনা করেন। তিনি অভিযোগ করেন, ক্ষমতাচ্যুত শাসক গোষ্ঠী ও তাদের দোসররা চুরি করা অর্থ ব্যবহার করে ভুয়া তথ্য ছড়ানোর মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চালাচ্ছে। তারা ফেব্রুয়ারির নির্বাচন চায় না। কিছু আন্তর্জাতিক মহলও তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে। জবাবে মহাসচিব গুতেরেস বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণ ও সংস্কার কর্মসূচির প্রতি জাতিসংঘের দৃঢ় সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন। পাশাপাশি রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানে বৈশ্বিক পর্যায়ে জাতিসংঘের ধারাবাহিক ভূমিকার প্রতিশ্রুতি দেন। একই দিন অস্ট্রেলিয়ার সাবেক ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমানে জাতিসংঘের মিয়ানমারবিষয়ক বিশেষ দূত জুলি বিশপের সঙ্গে অধ্যাপক ইউনূসের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, রোহিঙ্গা জনগণকে তাদের মাতৃভূমিতে প্রত্যাবাসন করাই এ দীর্ঘস্থায়ী সংকটের একমাত্র কার্যকর সমাধান। এর কোনো বিকল্প নেই। তিনি রোহিঙ্গাদের জন্য তহবিল সংকটের বিষয়ও জানান।
এদিকে গত ১৮ মাসে আরও প্রায় দেড় লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে বলে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর) ফিলিপ্পো গ্রান্ডিকে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। সোমবার তাদের মধ্যে বৈঠক হয়। ড. ইউনূস বলেন, নতুন করে আসা রোহিঙ্গা ভয়াবহ মানবিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে এবং আঞ্চলিক উত্তেজনা বাড়িয়েছে। উভয় নেতা সংকটের মূল বিষয়গুলো নিয়ে গভীর আলোচনা করেন।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে সংবাদমাধ্যম জেটিওকে সাক্ষাৎকার দেন অধ্যাপক ইউনূস। সাংবাদিক মেহেদি হাসানের এক প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বর্তমানে ভারতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ভুয়া খবর ছড়ানো। বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর কোনো সহিংসতা হচ্ছে না। সহিংসতার অভিযোগ ভিত্তিহীন।
সোমবার অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক ক্যাথরিন রাসেল। তাদের আলোচনার মূল বিষয় ছিল চলমান রোহিঙ্গা সংকট। বাংলাদেশের শিবিরে আশ্রয় নেওয়া ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার জন্য মানবিক কার্যক্রমে তহবিল ঘাটতির বিষয়টি ক্যাথরিনকে জানান অধ্যাপক ইউনূস। তিনি বলেন, তহবিল ঘাটতির কারণে ইতোমধ্যেই বহু স্কুলের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। পাশাপাশি কয়েক হাজার রোহিঙ্গা শিক্ষককে চাকরি হারাতে হয়েছে।
অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে এক বৈঠকে বাংলাদেশের এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) থেকে উত্তরণের প্রস্তুতি নিরপেক্ষভাবে মূল্যায়নে সহায়তার ঘোষণা দেন জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল এবং স্বল্পোন্নত দেশ, স্থলবেষ্টিত উন্নয়নশীল দেশ এবং ক্ষুদ্র দ্বীপপুঞ্জের উন্নয়নশীল দেশের উচ্চ প্রতিনিধি রাবাব ফাতিমা। সোমবার নিউইয়র্কে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে তিনি এ ঘোষণা দেন।