রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বিশ্ব নেতৃত্বের কাছে সাতটি প্রস্তাব দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল জাতিসংঘের উদ্যোগে নিউইয়র্কে আয়োজিত ‘মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘুর পরিস্থিতি’ শীর্ষক উচ্চপর্যায়ের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্যে তিনি প্রস্তাবগুলো তুলে ধরেন। গতকাল নিউইয়র্ক স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় ও বাংলাদেশ সময় রাত ৮টায় জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ হলে এ সম্মেলন শুরু হয়। সম্মেলনে অন্তত ৭৫টি দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
জাতিসংঘ আয়োজিত এ সম্মেলনের মূল লক্ষ্য রোহিঙ্গা সংকটের প্রতি আন্তর্জাতিক মনোযোগ ধরে রাখা, রাজনৈতিক সমর্থন জোগাড় করা, সংকটের মূল কারণ ও মানবাধিকার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করা এবং একটি সুনির্দিষ্ট ও সময়সীমাবদ্ধ সমাধানের রূপরেখা তৈরি করা। রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণভাবে মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করার বিষয়ে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সম্মেলনে ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) প্রতিনিধিত্ব করছে তুরস্ক এবং গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিলের (জিসিসি) প্রতিনিধিত্ব করছে কুয়েত।
উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বিশ্বনেতাদের কাছে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দাবি করেন। তিনি বলেন, গণহত্যা শুরু হওয়ার আট বছর পেরিয়ে গেলেও রোহিঙ্গাদের দুর্দশা এখনো অব্যাহত রয়েছে। এই সংকট নিরসনে উদ্যোগ অপর্যাপ্ত, আর আন্তর্জাতিক অর্থায়নও মারাত্মক ঘাটতির মুখে পড়েছে। এই সংকটের উৎপত্তি মিয়ানমারে, এর সমাধানও মিয়ানমারেই নিহিত। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই মিয়ানমার ও আরাকান আর্মির ওপর কার্যকর চাপ প্রয়োগ করতে হবে, যাতে তারা রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন বন্ধ করে এবং নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও দ্রুত প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করে। এ সমাধানকে মিয়ানমারের বৃহত্তর রাজনৈতিক সংস্কারের কাছে জিম্মি করা যাবে না।
ড. ইউনূস রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানের জন্য সাতটি প্রস্তাবনা তুলে ধরেন। সেগুলো হলো-১. নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের জন্য একটি কার্যকর রূপরেখা প্রণয়ন এবং রাখাইনের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে; ২. মিয়ানমার ও আরাকান আর্মির ওপর কার্যকর চাপ প্রয়োগ করতে হবে, যাতে তারা সহিংসতা বন্ধ করে এবং টেকসই প্রত্যাবাসন শুরু করে। প্রথমে বাংলাদেশে সদ্য আগত এবং মিয়ানমারে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুতদের নিয়ে এ উদ্যোগ শুরু করতে হবে; ৩. রাখাইনকে স্থিতিশীল করার জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা সংগঠিত করার পাশাপাশি অগ্রগতি পর্যবেক্ষণে আন্তর্জাতিক বেসামরিক উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে; ৪. রোহিঙ্গাদের রাখাইন সমাজ ও শাসন কাঠামোয় টেকসই একীভূতকরণের জন্য আস্থা তৈরির পদক্ষেপ নিতে হবে; ৫. যৌথ প্রতিক্রিয়া পরিকল্পনায় দাতাদের পূর্ণ অর্থায়নের ব্যবস্থা করতে হবে; ৬. রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের জন্য দায়বদ্ধতা নিশ্চিত ও পুনর্বাসনমূলক বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে; ৭. মাদক অর্থনীতি ধ্বংস এবং সীমান্ত পারাপারের অপরাধ দমন করতে হবে।
তিনি বলেন, মানবিক সহায়তার অর্থায়ন কমে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে একমাত্র শান্তিপূর্ণ ও টেকসই পথ হলো প্রত্যাবাসন। এটি অনির্দিষ্টকালের আন্তর্জাতিক সুরক্ষার তুলনায় অনেক কম সম্পদসাপেক্ষ। রোহিঙ্গারা নিজেরাও বারবার তাদের দেশে ফেরার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। অবিলম্বে যারা সাম্প্রতিক সংঘাত এড়িয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের প্রত্যাবাসন শুরু করতে হবে। বাংলাদেশ এই সংকটের শিকার। আমরা বিপুল আর্থিক, সামাজিক ও পরিবেশগত ব্যয় বহন করছি। রাখাইন হয়ে বাংলাদেশে প্রবাহিত মাদকসহ সীমান্ত অপরাধ আমাদের সামাজিক কাঠামোকে হুমকির মুখে ফেলছে। দারিদ্র্য ও বেকারত্বসহ আমাদের উন্নয়ন-চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় আমরা বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের কর্মসংস্থান দিতে পারি না। আসুন আমরা এই দীর্ঘস্থায়ী সংকটের স্থায়ী সমাধানে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই। বাংলাদেশ এই লক্ষ্যে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত।