সিনেমা শুধু বিনোদন নয়, এটা একেক সময় একেক বিপ্লব! আর যদি প্রশ্ন আসে বাংলাদেশি অ্যাকশন সিনেমার ‘মাস্টার ব্লাস্টার’ মুহূর্ত কোনটি? উত্তরটা একদম পরিষ্কার- ‘লড়াকু’, যেখানে নায়ক শুধু নায়কই ছিলেন না, একজন জাত মার্শাল আর্ট যোদ্ধাও ছিলেন। সময়টা ১৯৮৬ সালের ১৬ আগস্ট। ঈদুল আজহার সকাল। মানুষ তখন কোরবানির খাসি কাঁধে তুলে কসাই খুঁজছে, আর হলে তখন উঠছে এক নতুন নায়কের জয়ধ্বনি- ‘এই যে! আমি রুবেল! আমি লড়াকু!’ শুধু মারামারি নয়, দর্শকের চোখে অজানা বিস্ময়, কানে গান, আর মনে তখনো মিশে আছে একটি কথা- বাংলাদেশেও এমন সিনেমা হয় নাকি! রুবেলকে নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন -পান্থ আফজাল
এক হাতে রিল, আরেক হাতে রেভলিউশন
‘লড়াকু’ ছিল সিনেমার ক্যানভাসে আঁকা এক ভিন্ন কাহিনি- সমুদ্রপাড়ের জীবন, জেলেদের সংগ্রাম, আর তার সঙ্গে স্যামুরাই ঘরানার অ্যাকশন! আর যিনি সেই আঁচড় কেটেছিলেন? পরিচালক শহীদুল ইসলাম খোকন। গুরু ছিলেন সোহেল রানা। গাড়িতে বসে খোকন যখন তাঁর স্বপ্নের চিত্রনাট্য শোনান, তখন গুরু একটাই বলেন, ‘এই ছবিতে হিরো হবে আমার ভাই। মার্শাল আর্ট জানে। ফুটবল খেলে। ঢাবির স্টুডেন্ট। বডি দেখলে বুঝবা, পর্দা ফাটায় দেবে।’
ঢাবির ছাত্র থেকে ঢালিউডের ব্রুসলি
ভাবুন তো, একজন ছেলে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র। সকালবেলা ক্লাস করে, বিকালে কারাতে শেখায়, আর সন্ধ্যায় হয়তো গেয়ে উঠছে, ‘মেঘ যদি সরে যায়...’। এই মানুষটাই যখন পর্দায় এলেন ‘লড়াকু’ হয়ে, তখন দর্শক শুধু তালি দেয়নি, কেউ কেউ নাকি চেয়ার থেকে উঠে কারাতে কিক মারার ট্রাইও দিয়েছেন! রুবেলের অভিনয় ছিল না, ছিল মাঠের খেলা, জিমের ঘাম, আর চোখে আগুন। তিনি ছিলেন বাস্তবের অ্যাকশন হিরো। কল্পনার নয়। শুটিংয়ে নিজেই করেছেন ঝুঁকিপূর্ণ স্টান্ট। এক দৃশ্যে ট্রলারের নিচে ঝুলে শট দেন, যা কল্পনা নয়; বাস্তব।
অলরাউন্ডার রুবেল...
সিনেমায় ঢোকার আগে রুবেল ছিলেন সোহেল রানার সহকারী পরিচালক। আর জানেন কি? তিনি চারটি সিনেমায় গানও গেয়েছেন! ‘হাবাগোবা পাগলারে’, ‘সেই মেয়ে যে হাসলেই ফুল ঝরে’। তাহলে কি তিনি আমাদের অ্যাকশন হিরো কাম প্লেব্যাক সুপারস্টার? একদম তাই!
ড্যানি বনাম রুবেল
একজন নায়ক, তো একজন খলনায়ক লাগে না? ঢুকে এলেন ড্যানি সিডাক, মার্শাল আর্ট জানেন, চোখে আগুন, কণ্ঠে বজ্র রুবেল-ড্যানির প্রথম লড়াই ছিল ঢালিউডের রিংয়ে রেসলম্যানিয়া। পর্দা তখন থিয়েটার নয়, মনে হচ্ছিল যেন ডব্লিউডব্লিউই!
গান দিয়েও মুগ্ধতা ‘লড়াকু’র
শুধু মারামারি নয়, এই সিনেমা দিয়েছিল কিছু অবিস্মরণীয় গান। ‘বুকে আছে মন, মনে আছে আশা’, ‘সুন্দর এই পৃথিবী, ভালো লাগে না তোমাকে কাছে না পেলে’। সুরকার আলম খান তাঁর মেলোডিতে একেবারে বাজিমাত করে দিলেন।
রুবেলের লড়াকু, কবির সুমনের ‘তোমাকে চাই’
নায়ক রুবেলের ‘লড়াকু’ এতটাই হিট ও জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, সেই সময় এর জনপ্রিয়তা দেশ ছেড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতজুড়ে। যার ফলশ্রুতিতে কবির সুমন তার বিখ্যাত গান ‘তোমাকে চাই’-এ রুবেলের ‘লড়াকু’ ছবি নিয়ে আলাদা পঙ্ক্তি সাজিয়ে গান গেয়েছেন। যা মানুষের মুখে মুখে ফিরে।
১৭টি হলে মুক্তি, তারপর? সিনেমার ইতিহাসে ঝড়!
‘লড়াকু’ মুক্তি পেয়েছিল মাত্র ১৭টি হলে। কিন্তু জনপ্রিয়তার এমন ঝড় উঠল, হলে হলে শুরু হলো টিকিট যুদ্ধ। দর্শক বলত, ‘রুবেল আছে, তো ভাবনাই নাই!’ প্রযোজকের লগ্নি ফেরত, লভ্যাংশের ঝাঁপি!
‘লড়াকু’-একটি সিনেমা নয়, একটি চেতনার নাম
৩৫ বছর পেরিয়ে গেছে। আজকের যুগে যেখানে ভিএফএক্স, ডাবল বডি আর গ্রিনস্ক্রিন, সেখানে ‘লড়াকু’ ছিল রক্ত, ঘাম, নিষ্ঠা আর ভালোবাসার প্রোডাকশন। এটা ছিল সেই সিনেমা, যেটা প্রমাণ করেছিল, বাংলাদেশেও অ্যাকশন হয়। আর রুবেল ছিলেন আমাদের ব্রুসলি, র্যাম্বো আর হৃদয়ের হিরো- একসঙ্গে। যদি কেউ বলে, ‘বাংলা অ্যাকশন সিনেমা কীভাবে শুরু হলো?’
চোখ বন্ধ করে বলা যায়, সিনেমার নাম লড়াকু। নায়কের নাম রুবেল।