সূর্যমুখী ফুলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ না হওয়ার মানুষ খুব কমই আছে। কিন্তু এর ভিতরে যে লুকিয়ে আছে গণিতের এক অসাধারণ খেলা, তা অনেকেই জানেন না। সূর্যমুখীকে তাই শুধু একটি শোভাময় উদ্ভিদ হিসেবে নয়, প্রকৃতির তৈরি এক ‘জ্যান্ত ক্যালকুলেটর’ হিসেবেও বিবেচনা করা যায়। এর ফুলের মাথায় অসংখ্য বীজের বিন্যাস কখনোই এলোমেলো নয়, বরং অনুসরণ করে নিখুঁত এক গাণিতিক সূত্র।
সূর্যমুখী ফুলের মাঝখানে থাকা বীজগুলোর বিন্যাস একটি সাধারণ বা আকস্মিক নকশা নয়। এটি প্রকৃতির একটি গভীর গাণিতিক দক্ষতা এবং বিবর্তনের এক চূড়ান্ত সাফল্যের লক্ষণ। আপনি যদি কখনো একটি পাকা সূর্যমুখী ফুলের কেন্দ্রস্থল ভালো করে দেখেন, তাহলে দেখতে পাবেন যে অসংখ্য ছোট ছোট বীজ একেবারে নিখুঁতভাবে সর্পিল আকারে সাজানো আছে। সর্পিল আকারে থাকা এই বীজগুলো দুটি দিকে বিস্তৃত হয়েছে। কিছু সর্পিল বিন্যাস ঘড়ির কাঁটার দিকে ঘোরে, আর কিছু ঘোরে ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই দুই দিকের সর্পিলগুলোর সংখ্যা সবসময়ই দুটি পরপর ফিবোনাচি সংখ্যা হয়। উদাহরণস্বরূপ, এক দিকে ৩৪টি সর্পিল থাকলে অন্যদিকে থাকবে ৫৫টি। অথবা একদিকে ৫৫টি থাকলে অন্যদিকে থাকবে ৮৯টি। ফিবোনাচি ধারা হলো সংখ্যার একটি বিশেষ ক্রম, যেখানে প্রতিটি সংখ্যা তার ঠিক আগের দুটি সংখ্যার যোগফলের সমান। এই ক্রমটি: ০, ১, ১, ২, ৩, ৫, ৮, ১৩, ২১, ৩৪, ৫৫, ৮৯-এভাবে চলতেই থাকে।
বীজগুলোর এই বিশেষ গাণিতিক বিন্যাসের পেছনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণ আছে। কারণটি হলো সর্বোচ্চ দক্ষতা অর্জন। বীজগুলোর এই নকশা তৈরি হয় একটি বিশেষ কোণের মাধ্যমে, যার নাম ‘গোল্ডেন অ্যাঙ্গেল’। এই কোণের মান প্রায় ১৩৭.৫ ডিগ্রি। গাছটি প্রতি একটি নতুন বীজকে বা ফুলের অংশকে তার আগেরটির সাপেক্ষে ঠিক এই কোণে স্থাপন করে।
এই সূত্রই সূর্যমুখীকে সাহায্য করে তার মাথার প্রতিটি জায়গাকে সর্বাধিকভাবে কাজে লাগাতে, যাতে প্রতিটি বীজ পর্যাপ্ত জায়গা ও আলো পায়। ফলে স্থান ও শক্তির এক অনন্য অপ্টিমাইজেশন ঘটে, যা উদ্ভিদের বেঁচে থাকার জন্য অত্যন্ত কার্যকর। শুধু বীজের বিন্যাস নয়, সূর্যমুখীর কাণ্ডও যেন নিজস্ব ক্যালকুলেশন করে চলে। ছোট অবস্থায় এটি সূর্যের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতে থাকে। সকালে পূর্ব দিকে মুখ করে, দিনের বেলায় ধীরে ধীরে পশ্চিমে চলে যায়, আবার রাতে ফিরে আসে পূর্বমুখী হয়ে। এই আচরণকে বলা হয় হেলিওট্রপিজম। এর ফলে সূর্যমুখী গাছ দিনের প্রতিটি মুহূর্তে সূর্যের আলো সবচেয়ে বেশি গ্রহণ করতে পারে, যা তার দ্রুত বৃদ্ধি ও শক্তি সঞ্চয়ের জন্য অপরিহার্য।
লেখক : পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়