সবুজ ঘাসের মাঠখানির পাশেই বিশাল বিশাল দুটো ভবন। আলহাজ্ব আহেদ আলী বিশ্বাস স্কুল ও কলেজ। আমার সঙ্গে বসুন্ধরা শুভসংঘের বন্ধুরা। পাবনা শহরের কিছুসংখ্যক শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি ও সাংবাদিকরা। আমরা ভবনের দিকে হাঁটছি। পাশ থেকে একজন বললেন, ‘আহেদ আলী বিশ্বাস সাহেব হচ্ছেন অ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসের পিতামহ বা দাদা। শিমুল বিশ্বাস রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। বিএনপির উচ্চপর্যায়ের নেতা। তাঁরা সব ভাই-বোন মিলে পিতামহের নামে এই কল্যাণ ট্রাস্ট তৈরি করেছেন। যে সম্পদ কল্যাণ ট্রাস্টের জন্য দান করেছেন তার বাজারমূল্য দেড় দুশো কোটি টাকার মতো হবে।’
দেড় দুশো কোটি টাকার সম্পদ মানুষের কল্যাণের কাজে দান করতে বুকের পাটা লাগে। কতটা মানবপ্রেমী হলে এটা সম্ভব তা ভাববার বিষয়। আহেদ আলী বিশ্বাস সাহেব তাঁর সন্তান ও পৌত্র-পৌত্রীদের নিজের মতো করেই তৈরি করতে পেরেছিলেন। সৎ, নির্লোভ ও মানবকল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ পৌত্র-পৌত্রীরা পিতা ও পিতামহের পথই অনুসরণ করেছেন। নির্দ্বিধায় দান করেছেন নিজেদের প্রাপ্য সম্পদ। এখন ট্রাস্টটির কেন্দ্রবিন্দু অ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস। তিনিই প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান। শিমুল বিশ্বাসের সঙ্গে আমার পরিচয় দীর্ঘদিনের। তিনি জনমানুষের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিত্ব। তাঁর সততার কথা সর্বজনবিদিত। পাবনায় শিমুল বিশ্বাসের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। কারণ একটাই, তিনি মানুষের কল্যাণে কাজ করেন। দরিদ্র অসহায় মানুষের পাশে থাকেন।
মানুষের কল্যাণে যাঁরা কাজ করেন সে-ই সব মানুষের প্রতি সব সময়ই আমার বিশেষ শ্রদ্ধাবোধ কাজ করে। তাঁদেরকেই আমার প্রকৃত মানুষ মনে হয়, যে মানুষ শুধু নিজের স্বার্থের কথা ভাবেন না। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকেন না। শুধু নিজের উন্নতির আশায় মত্ত থাকেন না। যে মানুষ সমাজের অন্য মানুষের কথাও ভাবেন। পিছিয়েপড়া মানুষকে সামনে টেনে আনার চেষ্টা করেন। অসহায় মানুষের সহায় হন। কষ্টে থাকা মানুষের কষ্ট লাঘবের চেষ্টা করেন। অন্ধকার জীবনে থাকা মানুষের সামনে আলো জ্বালিয়ে দেন যাতে মানুষটি পথ চলতে পারে। আমার কাছে এই মানুষেরাই মানুষ।
একবার এক কাগজের মফস্বল পাতায় ছোট্ট একটা খবর চোখে পড়েছিল। খবরটির সঙ্গে একটা ছবিও ছিল। এক হতদরিদ্র মহিলার সামনে বসে আছে পাঁচজন প্রতিবন্ধী পথশিশু। মহিলা তাদের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন। মানুষটি ভিখিরি। সংসারে তার কেউ নেই। মধ্য বয়সি। রেললাইনের ধারে ঝুপড়ি তুলে থাকেন। পাঁচটি প্রতিবন্ধী পথশিশুকে তিনি নিজের সঙ্গে রেখেছেন। সকালবেলা শিশু পাঁচটিকে নাশতা খাইয়ে মহিলা বেরিয়ে যান ভিক্ষে করতে। দুপুরে এসে পাঁচজন শিশুকে রান্না করে খাওয়ান। আবার বেরিয়ে যান ভিক্ষে করতে। সন্ধ্যার পর ফিরে আবার শিশুগুলোকে রান্না করে খাওয়ান। ওই পর্যায়ের একজন মানুষের এই মানবিকতা ও মানুষের প্রতি মমত্ববোধ দেখে আমার চোখে পানি এসেছিল। ভিক্ষে করে যেটুকু আয় করেন তার সবই পাঁচ প্রতিবন্ধী শিশুর জন্য ব্যয় করেন। সে-ই ভিখিরি মানুষটিকে আমার সমাজের বহু বড় মানুষের তুলনায় অনেক অনেক বড় মনে হয়েছে।
১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫। বসুন্ধরা শুভসংঘের টিম নিয়ে আমি গিয়েছি পাবনায়। আমাদের অনেক কাজের একটি হচ্ছে বিভিন্ন জেলায় তিন চারটি বা পাঁচটি সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা। একজন ট্রেনার থাকেন। তার বেতন ও যে ঘরটিতে ট্রেনিং সেন্টার করা হয়, সে-ই ঘরের ভাড়া এবং অন্যান্য খরচ আমরা বহন করি। প্রতিটি সেন্টারে বিশজন করে অসচ্ছল নারীকে বিনাখরচে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রতি সপ্তাহে শুক্র ও শনিবারে চলে প্রশিক্ষণ। ১২ সপ্তাহের প্রশিক্ষণের পরে বিনামূল্যে তাদের একটি করে সেলাই মেশিন আমরা উপহার দিই। যাতে এই মেশিনটি ব্যবহার করে মানুষটি স্বাবলম্বী হতে পারেন। সারা দেশে এ পর্যন্ত প্রায় তিন হাজার অসচ্ছল নারীকে সেলাই মেশিন উপহার দিয়ে স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করেছি আমরা। উদ্যোগটি চলমান।
আমি শুভসংঘ প্রতিষ্ঠা করেছিলাম ২০১০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। সংগঠনটি তৈরি করা হয়েছিল দৈনিক ‘কালের কণ্ঠ’ পত্রিকার পাঠক সংগঠন হিসেবে। নাম ছিল ‘কালের কণ্ঠ শুভসংঘ’। দিনে দিনে সংগঠনটি বড় হয়ে ওঠে। আমাদের কার্যক্রমও ব্যাপক আকার ধারণ করে। ‘শুভ কাজে সবার পাশে’ এই সেøাগান মাথায় নিয়ে আমরা এগোতে থাকি। এই মুহূর্তে সারা দেশে ৩০০’র বেশি শাখা রয়েছে আমাদের। প্রায় ছ’-সাত লাখ ছেলে-মেয়ে সংগঠনটির সঙ্গে জড়িত। কয়েক বছর আগে সংগঠনটির নাম বদলে ‘বসুন্ধরা শুভসংঘ’ করা হয়। ‘বসুন্ধরা শুভসংঘ’র কার্যক্রম পরিচালিত হয় বসুন্ধরা গ্রুপের অর্থায়নে।
শুরু থেকেই অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছি আমরা। সেলাই মেশিনের কথা আগেই বলেছি। এই মুহূর্তে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের প্রায় তিন হাজার ছেলে-মেয়েকে মাসিক বৃত্তি দিই। ‘বসুন্ধরা শুভসংঘ স্কুল’ নামে ২২টি স্কুল আছে আমাদের। এমন সব প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্কুলগুলো প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যেখানটায় শিক্ষার আলো পৌঁছায়নি। দিনে দিনে স্কুলের সংখ্যা আমরা বাড়াতেই থাকব। ‘বসুন্ধরা শুভসংঘ পাঠাগার’ আছে ১০টি। পাঠাগারের সংখ্যাও ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকবে। ছাত্রবৃত্তি বেড়ে কমপক্ষে পাঁচ হাজারের মধ্যে যাবে ২০২৬ সালের মধ্যে। গৃহহীনকে ঘর তৈরি করে দেওয়া, অসচ্ছল পরিবারগুলোকে সচ্ছল করার জন্য গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি কিনে দেওয়া, ভ্যানগাড়ি কিনে দেওয়া, দোকান করে দেওয়া, হুইল চেয়ার কিনে দেওয়া, এসব কাজ আমরা শুরুর দিকে নিয়মিত করেছি। করোনার সময় উত্তরবঙ্গের ১৬ জেলার ৪৮ হাজার মানুষকে এক মাসের খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়েছিল। শুভসংঘের পরিচালক জাকারিয়া জামানের নেতৃত্বে জীবনের মায়া না করে আমাদের ছেলে-মেয়েরা এই কাজটি সমাধা করেছিল। ১০০ জন অসচ্ছল নারীকে সেলাই মেশিন বিতরণের জন্য পাবনায় গিয়েছিলাম আমরা। আহেদ আলী বিশ্বাস স্কুল ও কলেজ অডিটোরিয়ামে ওই ট্রাস্টের সহযোগিতায় মেশিনগুলো বিতরণ করেছিলাম। সে-ই ফাঁকে জেনেছিলাম কল্যাণ ট্রাস্টটি সম্পর্কে।
আলহাজ্ব আহেদ আলী বিশ্বাস মানবকল্যাণ ট্রাস্ট সংক্ষেপে ‘এবি ট্রাস্ট’। ট্রাস্টের একটি প্রোফাইল ছাপানো হয়েছে। প্রোফাইলটি আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। একটি করে পাতা উল্টাই আর আমার বিস্ময় বাড়তেই থাকে। বিভিন্ন সংস্থার অনুদানে এবি ট্রাস্টের তত্ত্বাবধানে এ পর্যন্ত ৪৩টি মাদ্রাসা, এতিমখানা, হেফজখানা ও জামে মসজিদ নির্মিত হয়েছে পাবনার বিভিন্ন এলাকায়। আরও অনেক প্রতিষ্ঠানের নির্মাণ প্রক্রিয়া চলমান। করোনাভাইরাসের সময় ২০২০ সালে হাজার হাজার দরিদ্র পরিবারকে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে, ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে শ্রমিক পরিবারগুলোতে। এতিম শিশুদের দেওয়া হয়েছে ঈদ উপহার হিসেবে নগদ টাকা। পরিবহন শ্রমিকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে ত্রাণ। সে সব ত্রাণ সহায়তার বিবরণ পড়ে আমি স্তম্ভিত হয়েছি। অসহায় মানুষের পাশে এভাবে দাঁড়িয়েছে একটি সংস্থা! এ এক মহান উদ্যোগ।
এবি ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠিত ছয়টি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের ভবনগুলো চোখে লেগে থাকার মতো। হাজার হাজার মানুষকে গৃহনির্মাণ সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। লক্ষাধিক বন্যার্ত মানুষকে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। রিকশা বিতরণ করা হয়েছে কয়েক শো। ক্রীড়াসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। স্বাবলম্বী করার জন্য সেলাই মেশিন বিতরণ করা হয়েছে নারীদের। আত্মকর্মসংস্থানের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চলেছে অজস্র। পুনর্বাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন বিষয়ক কর্মসূচি, নারীর ক্ষমতায়ন, যুব উন্নয়ন, ক্ষুদ্র অর্থায়ন, পরিবেশবিষয়ক কর্মসূচি, জৈব কৃষি ও চাষাবাদ, মাছ চাষ ও বাণিজ্যিক কর্মসূচি, সক্ষমতা ও উন্নয়ন, আইনি সহায়তা, কমিউনিটি মিডিয়া, পরিবহন শ্রমিকদের জন্য কল্যাণমূলক ও মানবসম্পদ উন্নয়ন কর্মসূচি। এসব কাজ নিয়মিত করছে এবি ট্রাস্ট। অভাবগ্রস্তদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দান ও তাদের জীবন সুন্দরভাবে গড়ে তুলতেই গড়ে উঠেছিল এবি ট্রাস্ট। নারী-শিশু, পরিবহনসহ অন্যান্য শ্রমিক ও সুবিধাবঞ্চিতদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচির মাধ্যমে ক্ষমতায়ন করার ধারণাও নিয়ে আসে এবি ট্রাস্ট। পাবনার পুরান কুটিপাড়া, কিসমত প্রতাপপুর এলাকায় গড়ে উঠেছে প্রতিষ্ঠানটি। সম্পূর্ণ অলাভজনক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের গ্রাম ও চর এলাকার মানুষের জন্যই ‘আহেদ আলী বিশ্বাস মানবকল্যাণ ট্রাস্ট’ প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৮৮ সাল থেকে এলাকার কয়েকজন সমাজসেবী সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে আসছিলেন। শুরুতে তাদের কাজ ছিল শিক্ষা ও কিছু সামাজিক কার্যক্রমের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ২০০১ সাল থেকে এবি ট্রাস্ট বৃহত্তর পরিসরে কাজ শুরু করে। সামাজিক উন্নয়ন, বিশেষ করে রাস্তাঘাট মেরামত, বন্যার্তদের জন্য আশ্রয়ণ, অবকাঠামো নির্মাণ, গৃহহীনদের জন্য গৃহনির্মাণ, কর্মহীনদের মধ্যে রিকশা ভ্যান ইত্যাদি বিতরণ ব্যাপকভাবে শুরু হয় ২০০১ সাল থেকে। ২০০৭ সালে ট্রাস্টটি নিবন্ধন করা হয়। এবি ট্রাস্ট এলাকায় লিঙ্গ সমতা, শিক্ষা, শ্রমিকদের কল্যাণ, স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। ফলে সমাজের দরিদ্র এবং বঞ্চিত মানুষের জীবনযাপনে নিরাপত্তা ও ক্ষমতায়নের কাজ করা সম্ভব হচ্ছে। পাবনার বহুমুখী উন্নয়নমূলক কর্মসূচি সফলতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করছে এবি ট্রাস্ট। শান্তি, মর্যাদা ও ঐক্য স্থাপন করে একটি গণতান্ত্রিক, দারিদ্র্যমুক্ত, ন্যায়বিচারের সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে টেকসই, কার্যকরী এবং খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃত হওয়ার জন্য কাজ করছে এবি ট্রাস্ট। প্রতিষ্ঠানটির এই হচ্ছে দর্শন।
এবি ট্রাস্টের কর্মপরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নের পদ্ধতি জেনে আমি খুবই আনন্দিত হয়েছি। সমাজের পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠীর সার্বিক উন্নয়নের জন্য যা যা প্রয়োজন, তার প্রায় সবগুলোর জন্যই কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। এরকম প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য অত্যন্ত জরুরি। যেরকম দুর্বার গতিতে মানুষের কল্যাণে এগিয়ে যাচ্ছে সংস্থাটি, তাদের এই গতি নিশ্চয় অব্যাহত থাকবে। দিনে দিনে আরও বিস্তৃত হবে তাদের কর্মক্ষেত্র। ভবিষ্যতের স্বপ্নের বাংলাদেশ তৈরিতে অসামান্য অবদান রাখবে প্রতিষ্ঠানটি, এতে আমার কোনো সন্দেহ নেই। এবি ট্রাস্টের সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেককে আমি অভিনন্দন জানাই। বিশেষ করে ট্রাস্টের চেয়ারম্যান শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসকে অভিনন্দন জানাই, তাঁর সুযোগ্য পরিচালনা ও নেতৃত্বের জন্য। এবি ট্রাস্টকে তিনি আরও অনেক অনেক উচ্চতায় নিয়ে যাবেন। এই ট্রাস্টের আলোয় আলোকময় করে তুলবেন পাবনা অঞ্চলকে, এই কামনা।
লেখক : কথাসাহিত্যিক