মৌমাছি দেখতে ছোট্ট ও সাধারণ মনে হলেও এরা পৃথিবীর ইকোসিস্টেমের এক অদৃশ্য সুপারহিরো। বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন, ‘মৌমাছি পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হলে মানবজাতি মাত্র চার বছর বাঁচবে।’ যদিও এই উক্তির সত্যতা নিয়ে বিতর্ক আছে, তবু মৌমাছির অবদান ছাড়া পৃথিবী যে ভয়াবহ সংকটে পড়ত, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
মৌমাছি ও অন্যান্য পরাগায়নকারী পোকামাকড় যেমন-প্রজাপতি, বাদুড় প্রায় ৭৫ শতাংশ ফসলের পরাগায়নে সাহায্য করে। শুধু মৌমাছিই পরাগায়ন করে প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদের। এই তালিকায় রয়েছে আম, জাম, লিচু, আপেল, নাশপাতির মতো আমাদের প্রিয় অনেক ফল ও সবজি। টম্যাটো, কুমড়ো, শসা, বেগুন, বাদাম ও বীজ জাতীয় ফসলের পরাগায়নে মৌমাছির ভূমিকা অপরিসীম। আমাদের প্রতিদিনের কফি ও কোকোর উৎপাদনও মৌমাছির ওপর নির্ভরশীল।
মৌমাছি যদি হঠাৎ করে পৃথিবী থেকে উধাও হয়ে যায় তাহলে প্রথম ধাক্কাটি আসবে খাদ্য উৎপাদনে। ফল ও শাকসবজির উৎপাদন কমে যাবে, খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙে পড়বে এবং বিশ্বজুড়ে খাদ্য ঘাটতি দেখা দেবে। মানুষের খাদ্যতালিকা তখন শুধু গম, ভাত এবং মাংসের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। এর ফলে পুষ্টির অভাব বিশেষ করে ভিটামিন ও মিনারেলের ঘাটতি দেখা দেবে, যা নানান রোগের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। কৃষিশিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। ধস নামবে বিশ্ব অর্থনীতিতে। অর্থনৈতিক দিক থেকে দেখলে জাতিসংঘের তথ্যানুযায়ী শুধু মৌমাছির পরাগায়নের অর্থনৈতিক মূল্য প্রতি বছর ২৩৫ থেকে ৫৭৭ বিলিয়ন ডলার।
প্রাকৃতিক দিক থেকে বিবেচনা করলে মৌমাছির অনুপস্থিতিতে গাছপালা কমে যাবে, বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের পরিমাণ হ্রাস পাবে, মাটির উর্বরতা নষ্ট হবে এবং বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে জীববৈচিত্র্য হারিয়ে যাবে। প্রকৃতির সৌন্দর্য ও ভারসাম্য রক্ষায় মৌমাছির ভূমিকা যে কতটা তা এই দৃশ্যকল্প থেকে সহজেই অনুমান করা যায়।
মৌমাছি না থাকলে মানুষ কি বাঁচত? এই প্রশ্নের জবার হলো হ্যাঁ, মানুষ বাঁচত কিন্তু জীবনযাত্রা হয়ে পড়ত অকল্পনীয় রকমের কঠিন। বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে কৃত্রিম উপায়ে পরাগায়নের চেষ্টা করছেন কিন্তু তা মৌমাছির মতো কার্যকর নয়। কিছু ফসল যেমন গম ও ধান বাতাসের মাধ্যমে পরাগায়িত হয় বলে সেগুলো টিকে যেত, কিন্তু বৈচিত্র্যপূর্ণ খাদ্য উৎপাদন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ত।
মৌমাছির সংখ্যা দিনদিন কমে যাওয়ার পেছনে প্রধান কারণগুলো হলো কীটনাশকের অত্যধিক ব্যবহার, জলবায়ু পরিবর্তন এবং তাদের বাসস্থান ধ্বংস করা। আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে মৌমাছিকে বাঁচাতে হবে। এজন্য বাগানে বা বারান্দায় স্থানীয় ফুলের গাছ লাগানো যেতে পারে, যাতে মৌমাছিগুলো খাদ্য পায়। কীটনাশকের ব্যবহার কমাতে হবে, বনভূমি রক্ষা করতে হবে এবং মৌমাছি চাষে উৎসাহিত করতে হবে।
মৌমাছি শুধু একটি পোকা নয়, এটি প্রকৃতির এক অমূল্য উপহার, যা আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গেই জড়িত। তাই মৌমাছি রক্ষা করা শুধু প্রকৃতির জন্য নয়, আমাদের নিজেদের জন্যও জরুরি।
লেখক : পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়