শিল্পের নামে গ্রিনহাউস গ্যাসের অনিয়ন্ত্রিত নিঃসরণে ঝুঁকিতে পৃথিবী। এতে বাড়ছে তাপমাত্রা। গলছে মেরু অঞ্চলের বরফ। বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। ধেয়ে আসছে একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ। সেখানে বিশ্বে মাথাপিছু সর্বোচ্চ (১৭.৬১ টন কার্বন ডাইঅক্সাইড সমতুল্য) গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণকারী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য গ্রিনহাউস গ্যাস নিয়ন্ত্রণের সব বিধিনিষেধ থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। এ জন্য ২০০৯ সালে নিরাপদ বায়ু আইনের আওতায় জারি করা এন্ডেঞ্জারমেন্ট ফাইন্ডিং বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। এমনকি কার্বন ডাইঅক্সাইডকে গ্রিন হাউস গ্যাসের তালিকা থেকে বাদ দিতে চাইছে দেশটি। এ সিদ্ধান্তকে শুধু আমেরিকা নয়, সারা বিশ্বের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছেন পরিবেশবিদ ও জলবায়ু গবেষকরা। এমনকি প্রতিবাদ এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য থেকেও।
আমেরিকার পরিবেশ সুরক্ষা সংস্থা (ইপিএ) চলতি মাসের শুরুতে ২০০৯ সালের এন্ডেঞ্জারমেন্ট ফাইন্ডিং বাতিল করার ঘোষণা দিয়েছে। এ আইনের ওপর ভিত্তি করেই যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিনহাউস গ্যাস উৎপাদনের উৎসগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছিল। সংস্থাটির মতে, গাড়ি ও শিল্পে নির্গমন কমাতে কড়া নিয়ম করলে উপকারের চেয়ে ক্ষতি বেশি হবে। ইপিএ প্রশাসক লি জেলডিন বলেছেন, পরিবেশ রক্ষার যুক্তি দিয়ে জো বাইডেনের জমানায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর জন্য কার্বন দূষণের যে মান স্থির করা হয়েছিল, তা মার্কিন অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এন্ডেঞ্জারমেন্ট ফাইন্ডিং বাতিল করলে আমেরিকানরা অর্থ সাশ্রয় করতে পারবে। গত দুই দশকে তৈরি হওয়া কার্বন ডাইঅক্সাইড, মিথেনসহ গ্রিনহাউস গ্যাস কমানোর নিয়ম শিথিল হয়ে যাবে। এরপর লাইট-ডিউটি, মিডিয়াম-ডিউটি এবং হেভি-ডিউটি যানবাহন ও ইঞ্জিনের সব নির্গমন মানদণ্ডও বাতিল করা হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য কার্বন ডাইঅক্সাইড অন্যতম দায়ী মনে করা হলেও ইপিএ বলছে, এতদিন কার্বন ডাই অক্সাইডকে যতটা ‘দূষণকারী’ মনে করা হতো আদৌ তা নয়। তাই ‘গ্রিনহাউস’ গ্যাসের তালিকা থেকে এটাকে বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। যদিও এন্ডেঞ্জারমেন্ট ফাইন্ডিংয়ে বলা হয়েছিল, কার্বন ডাইঅক্সাইডের মতো গ্রিন হাউস গ্যাস মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য বিপজ্জনক, তাই এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। আমেরিকার ‘ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফিয়ারিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ (এনওএএ)-এর তালিকায় দীর্ঘদিন ধরেই ‘ক্ষতিকর’ হিসেবে চিহ্নিত কার্বন ডাইঅক্সাইড। স্বাস্থ্যের পক্ষে বিপজ্জনক ‘গ্রিনহাউস’ গ্যাসের তালিকাতেও রয়েছে এই গ্যাস।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী এবং আন্তর্জাতিক জলবায়ু অর্থনীতি বিশ্লেষক এম জাকির হোসেন খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এমনিতেই মাথাপিছু গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের শীর্ষে যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমান সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। এটা শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, পৃথিবীর জন্য বিপদ ডেকে আনবে। কারণ, বাতাস একটা নির্দিষ্ট দেশ বা অঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকে না। জলবায়ু পরিবর্তনে ভুক্তভোগী হয় বিশ্ব। আমরা আছি অন্যতম ঝুঁকিতে। আমেরিকা রাজনৈতিক, প্রশাসনিক নাকি বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে তা পরিষ্কার নয়। আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে বলা আছে, পরিবেশ রক্ষার সঙ্গে মানবাধিকার যুক্ত। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে সাময়িকভাবে আমেরিকান কোম্পানিগুলো লাভবান হলেও পরে ক্ষতির মুখে পড়বে। মামলা-জরিমানা হবে। কারণ, কেউ ছেড়ে দেবে না। আমাদের মতো এলডিসি দেশগুলোর উচিত এটা নিয়ে নিজেদের প্ল্যাটফর্মে আলোচনা করা। সবাই মিলে দূষণকারী দেশ ও কোম্পানিগুলোর পণ্যে কার্বন ট্যাক্স বসানো উচিত। যে কোম্পানির দূষণ বেশি, তাদের পণ্যে ট্যাক্স বেশি বসাতে হবে। তিনি বলেন, এমনিতে জলবায়ু পরিবর্তন ও বায়ুদূষণের জন্য দায়ী দেশগুলো জলবায়ু তহবিলের অর্থ ছাড় দিচ্ছে না। বাংলাদেশেরই পাওনা আছে ৫ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ডলার। আমেরিকা যেমন বিভিন্ন দেশকে শুল্কের ফাঁদে ফেলেছে। এলডিসি দেশগুলোর উচিত কার্বন ট্যাক্স বসিয়ে পাওনা আদায় করে নেওয়া। কপ সম্মেলনে কার্বন ট্রেডিংয়ের ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না। কারণ, কার্বন ট্রেডিংয়ের অর্থ পেতে যে পরিমাণ গাছ দরকার, সেটা আমাদের নেই। জলবায়ু গবেষক ও বিজ্ঞানীরা বলছেন, গ্রিনহাউস গ্যাস নিয়ে আসল বৈজ্ঞানিক প্রমাণ উপেক্ষা করে কিছু নির্বাচিত রিপোর্টের ভিত্তিতে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইপিএ। যদি এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয় এবং আদালত তা সমর্থন করেন, তাহলে ভবিষ্যতে কোনো প্রশাসনই যুক্তরাষ্ট্রে বড় উৎসগুলো (গাড়ি, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, শিল্প কারখানা) থেকে গ্রিন হাউস গ্যাস নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না।
এদিকে ইপিএর এই প্রস্তাবের ঘোর বিরোধিতা করেছে রাজ্যগুলো। ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল রব বোন্টাসহ একাধিক ডেমোক্র্যাট শাসিত রাজ্যের আইন কর্মকর্তারা ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনকে এন্ডেঞ্জারমেন্ট ফাইন্ডিং বাতিলের পরিকল্পনা থেকে সরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। তারা বলছেন, এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে যুক্তরাষ্ট্রের সব গ্রিনহাউস গ্যাস নিয়ন্ত্রণের আইনি ভিত্তি ভেঙে পড়বে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার প্রচেষ্টা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। রব বোন্টা বলেছেন, এই প্রস্তাব বেআইনি এবং এই সিদ্ধান্ত শক্তি দপ্তরের (ডিওই) একটি অসম্পূর্ণ, যাচাই-বাছাইহীন ও বৈজ্ঞানিকভাবে দুর্বল খসড়া রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে করা হয়েছে। এর মাধ্যমে গত ১৫ বছর ধরে সমর্থন পাওয়া জলবায়ু বিজ্ঞানের প্রমাণ উপেক্ষা করা হচ্ছে।
মিশিগানের অ্যাটর্নি জেনারেল ডানা নেসেল বলেন, ইপিএর প্রস্তাব আসলে নিজের বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত অস্বীকার করে আইনগত দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা। জলবায়ু পরিবর্তন ও এর জন্য দায়ী দূষণ থেকে কোনো রাজ্যই নিরাপদ নয়।