কৃষ্ণচূড়া-জারুলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয় না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ফুল ফোটার মৌসুমে সেজেগুজে জারুল, কৃষ্ণচূড়া, সোনালু গাছের সামনে পড়ে যায় ছবি তোলার হিড়িক। একসময় এই ভূখণ্ডে গোলা অঞ্জন নামের আরেকটি ফুলের রং ও গন্ধ সৌন্দর্যপিপাসুদের মনে দোলা দিত। একই গাছে দেখা মিলত নানান রঙের মিশেলে চোখ জুড়ানো ফুলের সমাহার। ফুল ফুটলে পুরো গাছটি হয়ে উঠত বর্ণিল। ফুলের হালকা মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে পড়ত আশপাশের এলাকায়। তবে বর্তমান প্রজন্মের কাছে সেই গাছটি অপরিচিত। প্রকৃতির ওপর মানুষের নির্মমতায় হারিয়ে গেছে গোলা অঞ্জন। হারিয়ে গেছে ফিতাচাঁপা ফুলও। উদ্ভিদের ওই প্রজাতিগুলোকে বিলুপ্ত ঘোষণা করেছে বন বিভাগ। মানে গত ১০০ বছরের মধ্যে দেশের কোথাও গাছগুলোকে আর দেখা যায়নি।
বিলুপ্তির তালিকায় যুক্ত হয়েছে আরও পাঁচটি প্রজাতি। সেগুলো হলো-কুড়াজিরি, ভানু দেয়পাত, সাত সারিলা, থার্মা জাম ও মাইট্রাসিস। দেশের অধিকাংশ মানুষ নামই জানে না গাছগুলোর। নতুন প্রজন্মকে সচেতন করতে তাদের কাছে পরিচিত করিয়ে দিতে বই-পুস্তকেও ঠাঁই হয়নি এসব হারিয়ে যাওয়া গাছের। শুধু তাই নয়, মহাবিপন্ন অবস্থায় আছে আরও পাঁচ প্রজাতির উদ্ভিদ। সেগুলো হলো-বাঁশপাতা, বনখেজুর, বালবোরক্স, লম্বা ট্রায়াস অর্কিড ও বলগাছ। অর্থাৎ এগুলো সংরক্ষণে জরুরি পদক্ষেপ না নিলে অচিরেই সেগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাবে। সচেতনতা ও সংরক্ষণের অভাবে আমাদের অগোচরেই এভাবে হারিয়ে যাচ্ছে বহু স্থানীয় গাছ। আর সেই জায়গা দখল করছে নানান মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা হরেক প্রজাতির আগ্রাসী গাছ। সর্বশেষ জরিপে স্থানীয় প্রজাতির জন্য হুমকি এমন ১৭টি আগ্রাসী গাছের সন্ধান পেয়েছে বন বিভাগ।
গত বছরের শেষ দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বাংলাদেশে উদ্ভিদের লাল তালিকা’ প্রকাশ করে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। সেখানে এক হাজার উদ্ভিদ প্রজাতির লাল তালিকা করা হয়েছে। দেশের চারজন জ্যেষ্ঠ উদ্ভিদবিজ্ঞানীর নেতৃত্বে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) এই তালিকা প্রকাশ করে। তাতে দেখা যায়, দেশের সাতটি প্রজাতির উদ্ভিদ একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পাঁচটি প্রজাতি মহাবিপন্ন অবস্থায় আছে। ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত অবস্থায় আছে ২৭১টি প্রজাতি। বিপদাপন্ন আছে ৩৯৫টি প্রজাতি। বিপন্ন ১২৭টি, সংকটাপন্ন ২৬৩টি, ২৫৬ প্রজাতির তথ্য-অপ্রতুল ও ৭০টি প্রজাতিকে প্রায় বিপদগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অর্থাৎ, জরিপ করা উদ্ভিদের ৩৯ শতাংশই কোনো না কোনোভাবে বিপদাপন্ন।
বাংলাদেশ ন্যাশনাল হারবেরিয়ামের তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে উদ্ভিদ প্রজাতির সংখ্যা ৩ হাজার ৮৪০। এরপর আরও ১০টি প্রজাতি আবিষ্কৃত হয়। এদিকে একটি গবেষণায় বাংলাদেশে ৫ হাজারের বেশি, আরেকটি গবেষণায় ৩০০ প্রজাতির বিদেশি উদ্ভিদসহ বাংলাদেশে ৬ হাজার প্রজাতির উদ্ধিদের কথা বলা হয়েছে। এনসাইক্লোপিডিয়া অব ফ্লোরা অ্যান্ড ফনা অব বাংলাদেশ-এ বাংলাদেশে ৩ হাজার ৮১৩ প্রজাতির উদ্ভিদের তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ দূষণ ও বিদেশি আগ্রাসী গাছের কারণে বাংলাদেশে স্থানীয় গাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। সর্বশেষ প্রতিবেদনে ১ হাজার প্রজাতির গাছের মূল্যায়ন করা হয়েছে। বাকি আরও প্রায় ৩ হাজার প্রজাতির দ্রুত মূল্যায়ন করা জরুরি। তাহলে বোঝা যাবে দেশে সত্যিকার অর্থে কতগুলো প্রজাতি টিকে আছে।
এদিকে অর্ধ ডজনের বেশি সরকারি দপ্তরের ওপর রয়েছে গাছ ও প্রকৃতি রক্ষার দায়িত্ব। প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন দিবসে সভা, সেমিনার, র্যালি করে বড় অঙ্কের অর্থ খরচ করলেও গাছ ও প্রকৃতি রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না বলে অভিযোগ পরিবেশবাদীদের। তারা বলছেন, এর আগে ২০১২ সালে বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার ৫৪টি উদ্ভিদ প্রজাতি সংরক্ষিত ঘোষণা করে। উদ্ভিদগুলো হলো-তালিপাম, হাতিশুঁড়, সিভিট, বইলাম, চুন্দুল, কুম্ভি, প্রশান্ত আমুর, ধুপ, কাঁটালাল বাটনা, কর্পূর, তেজবহুল, মণিরাজ, অনন্তমূল, পুদিনা, বাঁশপাতা, উরি আম, পাদাউক, রিটা, জায়না, উদাল, হাড়জোড়া, ত্রিকোণী বট, লতা বট, গয়া অশ্বত্থ, উর্বশী, উদয় পদ্ম, জহুরী চাঁপা ইত্যাদি। আইন অনুযায়ী এই ৫৪ প্রজাতির উদ্ভিদগুলো কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে ওঠানো, উপড়ানো, ধ্বংস বা সংগ্রহ করতে পারবে না। আইন ভঙ্গ করলে এক বছরের কারাদণ্ড অথবা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে। একই অপরাধ দ্বিতীয়বার করলে শাস্তি দ্বিগুণ হবে। তবে এই আইনে কাউকে কখনো শাস্তি দেওয়া হয়েছে বলে শোনা যায়নি। কারণ, কেউ এটা করছে কি না তা দেখার কেউ নেই। সাধারণ মানুষের সঙ্গে গাছগুলোকে পরিচিত করার ব্যবস্থা করা হয়নি। এমনকি যারা আইন বাস্তবায়ন করবেন, তাদের অধিকাংশের কাছেই গাছগুলো অপরিচিত। ক্ষতিকর বিবেচনায় সম্প্রতি ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি গাছ রোপণ নিষিদ্ধ করা হলেও নার্সারিগুলোতে অবাধে বিক্রি হচ্ছে এসব গাছের চারা।
শুধু বাংলাদেশ নয়, বিলুপ্ত প্রাণীর মতো সারা পৃথিবী থেকে গাছ হারিয়ে যাচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয় সামনে আসার পর প্রজাতি বিলুপ্তির বিষয়টি এখন আলোচনার টেবিলে ঝড় তুলছে। অর্ধযুগ আগে এক সমন্বিত গবেষণায় বলা হয়-গত আড়াই শ বছরে পৃথিবী থেকে প্রায় ৬০০ প্রজাতির গাছ হারিয়ে গেছে। এ সংখ্যা একই সময়ে বিলুপ্ত পাখি, স্তন্যপায়ী প্রাণী ও সরীসৃপের মিলিত সংখ্যার দ্বিগুণ।