জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতে ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ অভিন্ন কয়েকটি দাবিতে রাজধানীতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে জামায়াতে ইসলামীসহ সাতটি ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দল। আলোচনার টেবিল ছেড়ে গতকাল তারা পৃথকভাবে বিক্ষোভ সমাবেশ করে। দলের কেউ ৫ দফা, কেউ ৬ দফা, কেউ ৭ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করলেও সবার মূল দাবি প্রায় একই। দলগুলোর অভিন্ন দাবি হলো- জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন, সংসদের উভয় কক্ষে পিআর পদ্ধতি চালু, অবাধ সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত, ফ্যাসিস্ট সরকারের সব জুলুম ও গণহত্যা, দুর্নীতির বিচার দৃশ্যমান করা এবং স্বৈরাচারের দোসর জাতীয় পার্টিসহ ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা। অন্তর্বর্তী সরকার এসব দাবি না মানলে সমাবেশ থেকে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন দলগুলোর শীর্ষ নেতারা।
এদিন বিকাল সাড়ে ৪টায় বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ গেটে জামায়াত, উত্তর গেটে বাদ জোহর ইসলামী আন্দোলন ও বাদ আসর বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বেলা ৩টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে খেলাফত মজলিস ও সাড়ে ১২টায় খেলাফত আন্দোলন, সাড়ে ৪টায় জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা) ও নেজামে ইসলাম পার্টি বিক্ষোভ করে।
বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেট বিকাল সাড়ে ৪টার আগেই নেতা-কর্মীদের উপস্থিতিতে কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়। বিক্ষোভ মিছিলের আগে সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘নির্বাচনের আগে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি না দিলে মহাবিপর্যয়ের মুখে পড়বে দেশ। আমরা বলেছি, নির্বাচনের আগেই সংবিধান আদেশ ও গণভোটের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে। এর ভিত্তিতে নির্বাচন হতে হবে। এই সংস্কার যদি নির্বাচনের আগে না হয় এবং বিদ্যমান কাঠামোয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে আবারও ফ্যাসিবাদের উত্থান হবে। আবারও আরেকটি শেখ হাসিনার জন্ম হবে। যা জনগণ মেনে নেবে না।’
মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন ‘জনগণ যদি গণভোটে পিআর না মানে, আমরা মেনে নেব। কিন্তু আপনারা গণভোটকে ভয় পাচ্ছেন কেন?’ একটি পক্ষের কারণে সরকার নিরপেক্ষতা হারাচ্ছে বলেও দাবি করেন তিনি।
জুলাই সনদ আইনির ভিত্তি ও পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন নিয়ে সরকারকে ‘গণভোট’ দেওয়ার আহ্বান জানান জামায়াত নেতারা। না হলে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন ঘেরাও করা হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন তাঁরা।
পিআর পদ্ধতির ব্যাপারে গণভোট দিন : ফয়জুল করীম : বিক্ষোভ মিছিল ও গণসমাবেশে ইসলামী আন্দোলনের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম শায়েখে চরমোনাই বলেন, ‘একাধিক জরিপে উঠে এসেছে দেশের অধিকাংশ মানুষ পিআর চায়। বিএনপি যদি ৯০ শতাংশ ভোট পেয়ে ২৭০ আসন নিয়ে এককভাবে দেশে পরিচালনা করে আমাদের তো সমস্যা নেই। জুলাই সনদের ভিত্তি ও পিআর পদ্ধতির (সংখ্যানুপাতিক হারে প্রতিনিধিত্ব) ব্যাপারে গণভোট দিন, জনগণ না চাইলে আর দাবি করব না। আমাদের দাবি স্পষ্ট সংস্কার করতে হবে, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিতে হবে, বিচার দৃশ্যমান হতে হবে এবং পিআরে নির্বাচন হতে হবে।’
জুলাই সনদ ব্যতীত নির্বাচন শহীদের সঙ্গে বেইমানি : জাগপা : বিক্ষোভ মিছিল শেষে প্রেস ক্লাবের সামনে জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) সহসভাপতি রাশেদ প্রধান বলেন, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ব্যতীত জাতীয় নির্বাচন শহীদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি। আগামী জাতীয় নির্বাচন জুলাই সনদের আলোকে হতে হবে। হিন্দুস্তানের সামনে আর মাথা নত করা যাবে না। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের বাংলাদেশের মাটিতে রাজনীতি করার আর কোনো অধিকার নাই। আমরা বাংলার মাটিতে আর নতুন কোনো স্বৈরাচার ফ্যাসিজম দেখতে চাই না। জাতীয় পার্টিসহ ১৪ দল নিষিদ্ধ করা এখন জনগণের দাবি।
খেলাফত মজলিস : আগামী দুই মাসের মধ্যে গণভোটের মাধ্যমে জুলাই সনদকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়েছেন খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশে তিনি বলেন, এ সরকারের আমলেই জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি প্রদান করতে হবে। ভবিষ্যতে যারা নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসবে তারা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করবে কি না, তা নিয়ে জনমনে সন্দেহ রয়েছে। তাই এই সরকারকেই জুলাই সনদ বাস্তবায়নের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে।
খেলাফত মজলিসের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি মাওলানা আজিজুল হকের সভাপতিত্বে সমাবেশে আরও উপস্থিত ছিলেন নায়েবে আমির আহমদ আলী কাসেমী, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব জাহাঙ্গীর হোসাইন, যুগ্ম মহাসচিব অধ্যাপক আবদুল জলিল প্রমুখ।
খেলাফত আন্দোলনের বিক্ষোভ : জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি, শাপলা চত্বর ও চব্বিশের গণ অভ্যুত্থানের গণহত্যার বিচারসহ ৭ দফা দাবিতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বিক্ষোভ মিছিল করে বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন। দাবি না মানলে দেশব্যাপী আরও কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন দলটির নায়েবে আমির মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদী। তিনি বলেন, শাহবাগ, ’২১ সালের হত্যা এবং ’২৪ সালের আন্দোলনের হত্যাকাণ্ডের বিচার আজও হয়নি।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস : বিক্ষোভ মিছিলে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা জালালুদ্দীন আহমদ বলেন, হাজার হাজার ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে সংঘটিত জুলাই বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষাকে নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্র চলছে। যারা আগামী সংসদের জন্য জুলাই সনদের বাস্তবায়ন ঠেলে দিতে চায়, তারা আসলে রাজনৈতিক সুবিধার খোঁজ করছে। গতকাল বাদ আসর ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের যৌথ উদ্যোগে বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেট থেকে মিছিল শুরু হয়ে প্রেস ক্লাব হয়ে দৈনিক বাংলার মোড়ে গিয়ে শেষ হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন দলটির যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আতাউল্লাহ আমিন, মাওলানা তোফাজ্জল হোসাইন মিয়াজি প্রমুখ।
নেজামে ইসলাম পার্টি : ৫ দফা দাবিতে বিকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি। এতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সংগঠনের সিনিয়র নায়েবে আমির আল্লামা আবদুল মাজেদ আতহারী বলেন, বাংলাদেশের জনগণের ভাগ্য নিয়ে তামাশা করলে আরেকটি গণ বিপ্লব সংঘটিত হবে। বাংলাদেশে পুনরায় ফ্যাসিবাদকে পুনর্বাসিত করার চক্রান্ত রুখে দিতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশ গড়তে উদাত্ত আহ্বান জানান তিনি।
ঢাকায় তীব্র যানজট : সাত দলের বিক্ষোভ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে রাজধানীর পুরানা পল্টন, বায়তুল মোকাররম ও প্রেস ক্লাব এলাকায় বিকাল থেকে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েন অফিসফেরত মানুষ। বেলা ৩টার দিকে পুরানা পল্টন মোড়, গুলিস্তান, বায়তুল মোকাররম গেট ও প্রেস ক্লাবের সামনে একযোগে বিক্ষোভ কর্মসূচি শুরু হয়। এ সময় বায়তুল মোকাররম গেট থেকে হাতপাখা প্রতীক নিয়ে একটি মিছিল পুরানা পল্টন মোড় ঘুরে দৈনিক বাংলা মোড়ে গিয়ে শেষ হয়। বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে জামায়াতের বিক্ষোভ মিছিলটি গুলিস্তান, পল্টন, মৎস্য ভবন হয়ে শাহবাগে গিয়ে শেষ হয়। পুলিশ মিছিলের নিরাপত্তায় দুই পাশের রাস্তায় যান চলাচল সাময়িক বন্ধ করে দিলে যানজট ছড়িয়ে পড়ে পুরো এলাকাজুড়ে।
আজ সারা দেশের মহানগরের বিক্ষোভ : একই দাবিতে আজ শুক্রবার সারা দেশের মহানগরের বিক্ষোভ মিছিল করবে দলগুলো। আগামী ২৬ সেপ্টেম্বর সব জেলা ও উপজেলায় বিক্ষোভ মিছিলের কর্মসূচি রয়েছে এই সাত ইসলামপন্থি দলের।