দ্রুত নগরায়ণ বড় শহরগুলোকে এক নতুন সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কাটা পড়ছে গাছ। উঁচু ভবন, কংক্রিট বা কাচের দেয়াল এবং যানবাহনের বাড়তি ব্যবহার ক্রমাগত তপ্ত করে তুলছে শহরকে। তৈরি হচ্ছে হিট আইল্যান্ড। শহরের তাপমাত্রা আশপাশের গ্রামীণ এলাকার তুলনায় অনেক বেড়ে যাচ্ছে। গরম কমাতে বাড়ছে এসির ব্যবহার, যা বাইরের তাপমাত্রাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। ফলে ক্রমেই বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে নগর। এই প্রেক্ষাপটে, নগরকে ঠান্ডা রাখতে ছাদবাগান কার্যকর সমাধান হতে পারে বলে মনে করছেন পরিবেশবিদরা। আন্তর্জাতিক নানান গবেষণায় দেখা গেছে- ছাদবাগান শুধু তাপমাত্রা হ্রাসই করে না, বায়ুদূষণ রোধ, শক্তি সাশ্রয়, খাদ্য উৎপাদন ও পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ইতালির বোলোনিয়া শহরে একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, সব ভবনের ছাদে সবুজ বাগান করা হলে বছরে প্রায় ৬২৪ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষিত হবে। নেপালের কাঠমান্ডু শহরে ২৫০ পরিবারকে ছাদবাগানে যুক্ত করে দেখা যায়, তারা নিজেদের শাকসবজির ৫০ ভাগ চাহিদা নিজেরাই মেটাতে পেরেছে এবং প্রতি বছর প্রায় ১১০ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন কমিয়েছে। পরিবেশবান্ধব ভবন হিসেবে সারা বিশ্বে সাড়া ফেলেছে জাপানের এসিআরওএস ফুকুওকা (অঈজঙঝ ঋঁশঁড়শধ) ভবনটি। ১৪ তলা ভবনটি ৩৫ হাজার গাছপালা দিয়ে আচ্ছাদিত, যা বছরে প্রায় সাড়ে ৪ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে। এ ছাড়া ভবনের শীতাতপ খরচ ৩০-৪০ ভাগ কমিয়েছে। একইভাবে এটি বছরে প্রায় ১৮ লাখ লিটার বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করতে পারে।
পরিবেশবিদরা বলছেন, নগরায়ণের কারণে ঢাকা শহরও দ্রুত বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। বায়ুদূষণে বিশ্বের মধ্যে শীর্ষে এই শহর। গাছ কাটা, একের পর এক বহুতল ভবন নির্মাণ, অতিরিক্ত যানবাহনের চাপ ও অধিক এসির ব্যবহার গ্রীষ্মকালে শহরের তাপমাত্রা অসহনীয় করে তুলছে। শীতকালে পাওয়া যাচ্ছে না শীতের আমেজ। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, শহুরে এলাকার ২৫ থেকে ৩০ ভাগ বৃক্ষ আচ্ছাদিত থাকা উচিত। সেখানে ঢাকা শহরে গাছের আচ্ছাদন আছে মাত্র ১১.৬ ভাগ, যা ১৯৮০ সালেও ছিল ২১ শতাংশের বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে প্রতিটা মানুষের জন্য ন্যূনতম ৯ বর্গমিটার সবুজ জায়গা থাকা জরুরি। সেখানে ঢাকায় প্রতিটা মানুষের বিপরীতে সবুজ জায়গা আছে সাড়ে ৩ বর্গমিটারের মতো। ফলে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত দিক দিয়ে চরম ঝুঁকিতে আছেন এই নগরের বাসিন্দারা। এই ঝুঁকি কমাতে ছাদবাগান হতে পারে সর্বোত্তম সমাধান।
পরিবেশবাদী সংগঠন গ্রিন সেভারস-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আহসান রনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ঢাকা শহরের বেশির ভাগ ভবনই পুরোনো হওয়ায় ছাদবাগানের উপযোগী নয়। তবে নতুন সাড়ে চার থেকে পাঁচ লাখ ভবনে পরিকল্পিত ছাদবাগান করা সম্ভব। এর মধ্যে মাত্র ৩-৪ শতাংশ ভবনের ছাদে পরিকল্পিত বাগান আছে। আরও ৬-৭ শতাংশ ভবনের মালিক শখের বসে ছাদে কিছু গাছ লাগিয়েছেন। সব ভবনের ছাদ সবুজে ঢেকে দিতে পারলে তাপমাত্রা ও বায়ুদূষণ কমাতে বড় ভূমিকা রাখবে। একই সঙ্গে এসির ব্যবহার কমবে, কার্বন নিঃসরণ কমবে, বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে, বাতাসে অক্সিজেন বাড়বে। তবে অনেক যৌথ মালিকানার ভবনে মতের অমিল থাকায় ছাদে বাগান হয় না। অনেকের গাছে আগ্রহ নেই। কারও আবার আগ্রহ থাকলেও রক্ষণাবেক্ষণ ও যত্ন করতে না পারায় পরে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এজন্য প্রথমে বিল্ডিং কোডে ছাদবাগান বাধ্যতামূলক করতে হবে। সরকারিভাবে নিয়মিত মনিটরিং ও ছাদবাগান করতে সব ধরনের পরামর্শ ও সহযোগিতা হাতের নাগালে আনতে হবে। বড় গাছগুলোকে রক্ষা করতে হবে।
এদিকে গবেষণায় দেখা গেছে, সবুজ ছাদ ভবনের ভিতরের তাপমাত্রা দশমিক ২-৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও বাইরের তাপমাত্রা দশমিক ২-৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কমাতে পারে। এতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন হ্রাস পায়। একইভাবে শীতে এটি তাপ ধরে রাখতে সহায়তা করে। ছাদের বাইরের পৃষ্ঠতলের তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৮৬% (১০-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) পর্যন্ত কমে যায়। ফলে ভবনের বিদ্যুৎ খরচ কমে এবং গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাস পায়। তবে একক ছাদবাগানের চেয়ে কমিউনিটিভিত্তিক ছাদবাগান বেশি কার্যকর। একক ভবনের ক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী বাতাসের তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমে; কিন্তু এলাকাভিত্তিক অনেক ছাদ সবুজ করা গেলে স্থানীয় তাপমাত্রা ৪-৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হ্রাস পায়। সবুজ ছাদ গড়ে ১০-৬০% পর্যন্ত বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে পারে, যা শহরের নালা বা স্যুয়ারেজ সিস্টেমের ওপর চাপ কমায়। ১০ তলা ভবনের ৫ হাজার স্কয়ার ফুট ছাদ সবুজ করলে ৩০০ থেকে ৩ হাজার ১৫৮ কিলোওয়াট-আওয়ার পর্যন্ত বিদ্যুৎ সাশ্রয় হতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছাদবাগানের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ জরুরি। ভবন কোডে সবুজ ছাদ বাধ্যতামূলক করতে হবে। কর রেয়াত, ভর্তুকি এবং প্রণোদনা দিতে হবে। ডেমো প্রজেক্ট ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। বাগান করতে সব ধরনের সহযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে। সরকারিভাবে তদারকির ব্যবস্থা করতে হবে। স্থানীয় জনগণকে সচেতন করে এবং কমিউনিটিভিত্তিক ছাদবাগান গড়ে তুলতে হবে।